সোমালি জলদস্যুদের উত্থান যেভাবে
প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৪, ১৬:৫৯
সোমালি জলদস্যুদের উত্থান যেভাবে
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

সোমালিয়ার উপকূলে জলদস্যুতা একবিংশ শতকের প্রথম দিকে সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক জাহাজগুলোর জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। ২০০৫ সাল থেকে, ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা, জলদস্যুতা ঘটনা বৃদ্ধির উপর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ওসানস বিয়ন্ড পাইরেসির এক জরিপ অনুসারে, জলদস্যুতার প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক জাহাজ কোম্পানিগুলোকে অতিরিক্ত খরচসহ বছরে প্রায় $৬.৬ থেকে ৬.৯ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে যা বিশ্ব বাণিজ্যে প্রভাব ফেলছে। জার্মান ইন্সটিটিউট ফর ইকোনমিক রিসার্চ এর এক জরিপে বলা হয়, জলদস্যুতার বৃদ্ধির ফলে জলদস্যুতার সাথে সম্পর্কিত লাভজনক প্রতিষ্ঠানের প্রকোপও বৃদ্ধি পেয়েছে। বীমা কোম্পানিগুলো জলদস্যু আক্রমণ থেকে মুনাফা অর্জন করছে, জলদস্যুতার প্রকোপ বৃদ্ধির জন্য বিমার প্রিমিয়ামের পরিমাণও বেড়ে গিয়েছে।


এদিকে আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগরে গতকাল মঙ্গলবার (১২ মার্চ) দুপুরে জলদস্যুদের কবলে পড়ে ‘এমভি আবদুল্লাহ’ নামে বাংলাদেশি পতাকাবাহী একটি জাহাজ। সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি আছেন জাহাজটির ২৩ জন নাবিক।


লোহিত সাগরে হুতিদের নিয়ে আন্তর্জাতিক বাহিনীগুলো বেশি ব্যস্ত থাকার সুযোগে ভারত মহাসাগরের গালফ অফ এডেনে তারা আবার মাথাচাড়া দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।


উত্থানের নেপথ্যে



ইতালিয়ান ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে ১৯৬০ সালে সোমালিয়ার জন্ম। ১৯৯১ সালে সামরিক শাসনের উৎখাতের পরে নৈরাজ্যের মধ্যে পড়ে দেশটি। পরের দুই দশকের বেশি সময় যুদ্ধবিগ্রহে বিধ্বস্ত সোমলিয়াতে কার্যকর কোনো সরকার ছিল না। এই সময়টাতে আফ্রিকার মধ্যে দীর্ঘতম উপকূল সমৃদ্ধ দেশটির জলসীমার নিরাপত্তায় কোনো কোস্টগার্ড বা বাহিনী ছিল না। এতে এই অঞ্চলে বিদেশি মাছ ধরা নৌযানের উপস্থিতি ক্রমশ বাড়তে থাকে। এতে স্থানীয় জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। ফলে, তারা দস্যুবৃত্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে। ইন্ডিয়ান ওশান কমিশনের সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতেও ওই সময়ের দস্যুতার নেপথ্যে এই কারণ হিসেবে দেখা হয়েছে। তাছাড়া, মৎস্য শিকারের চেয়ে দস্যুতায় আয়ের পরিমাণও অনেকগুণ বেশি।


তবে, কয়েক বছর তাদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো ওই রুটে তাদের সামরিক উপস্থিতি বাড়ায়। এর ফলে ২০১২ সাল নাগাদ অনেকটাই স্তিমিত হয়ে আসে দস্যুবৃত্তি।


সাম্প্রতিক হামলা


গত কয়েক মাসে সোমালি জলদস্যুদের তৎপরতা বেড়েছে। পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে সামুদ্রিক নিরাপত্তা বিধানে কাজ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনী বা ইইউন্যাভ ফর আটালান্টা। তাদের মতে, গত বছরের নভেম্বরে থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে সোমালি উপকূলে অন্তত ১৪টি জাহাজ হাইজ্যাক করা হয়েছে। এর মধ্যে ইরানের পতাকাবাহী একটি মাছ ধরার নৌকা এবং লাইবেরিয়ান-পতাকাবাহী সেন্ট্রাল পার্ক নামের একটি জাহাজের জেলে ও নাবিকদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়।



সেন্ট্রাল পার্কের উদ্ধার তৎপরতায় মার্কিন নৌবাহিনী জড়িত ছিল। পরে তারা জানায়, এটা স্পষ্টতই দস্যুতা এবং আক্রমণকারীরা সম্ভবত সোমালিই ছিল। ডিসেম্বরে এমভি রুয়েন নামে মাল্টার পতাকাবাহী একটি জাহাজ হাইজ্যাক করা হয়। এখনো জাহাজের নিয়ন্ত্রণ হামলাকারীদের হাতে। জিম্মি আছেন ১৭ জন ক্রু।


ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরো- আইএমবি’র মতে, এটি ছিল ছয় বছরের মধ্যে সোমালিয়ায় প্রথম সফল হাইজ্যাকিং। আইএমবি একটি প্রভাবশালী অলাভজনক সংস্থা যা সামুদ্রিক অপরাধ মোকাবেলা করার লক্ষ্যে কাজ করে।


জানুয়ারিতে, ভারতীয় নৌবাহিনী ব্যাপক অভিযান চালায়। এক সপ্তাহে তিনটি অভিযানে ১৯ জন জিম্মিকে মুক্ত করতে সমর্থ হয় তারা। তাদের মধ্যে ১১ জন ইরানি নাগরিক বাকিরা পাকিস্তানি। ভারতীয় বাহিনীর তরফে জানানো হয় ‘এদের সবাই সোমালি দস্যুদের হাতে বন্দি ছিলেন।’


বিবিসির রিয়েলিটি চেক টিমের প্রতিবেদন বলছে, শুধু ২০১৮ সালেই পূর্ব আফ্রিকান জলসীমায় ১১২টি নৌ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। যার সর্বশেষ শিকার বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ। কয়লা নিয়ে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে দুবাইয়ের দিকে যাওয়ার পথে মঙ্গলবার ২৩ জন ক্রুসহ জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেয় জলদস্যুরা।


হুতিদের ঠেকাতে গিয়ে অরক্ষিত সোমালিয়া উপকূল


দস্যুরা স্বভাবতই সুযোগসন্ধানী। তারা নিরাপত্তাবাহিনীকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে নানাভাবে। এবার পূর্ব আফ্রিকা উপকূলে নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতিকে কাজে লাগাচ্ছে তারা। ২০০৫ থেকে ২০১২ সালে ব্যাপকভাবে জলদস্যুতা বেড়ে গিয়েছিল। তখন আন্তর্জাতিক বাহিনী ওই জলসীমায় টহল জোরদার করে। কিন্তু সম্প্রতি লোহিত সাগরে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠী বেশ কিছু জাহাজে আক্রমণ করায় পশ্চিমা বাহিনীগুলোকে সেইদিকে বেশি নজর দিতে হয়েছে।



দেড় দশক আগে প্রথম দফায় জেলেরা যে দস্যুতায় জড়িয়ে পড়েছিল, তার অন্যতম কারণ, বিদেশি ট্রলার এসে তাদের এলাকায় অবৈধভাবে মাছ ধরতো। ফলে, স্থানীয় জেলেরা জীবিকার সংকটে পড়ে ডাকাতিকে পেশা নিতে বাধ্য হয়।


দস্যুদের উদ্দেশ্য কী? আয় কেমন?


ত্রিকোণাকৃতির ভৌগোলিক মানচিত্রের কারণে পূর্ব আফ্রিকা অঞ্চলকে হর্ন অব আফ্রিকা বলা হয়। ২০০৫ থেকে ২০১২ পর্যন্ত সময়কালে হর্ন অব আফ্রিকার দস্যুরা কী পরিমাণ অর্থ আদায় করেছে তার একটি আনুমানিক হিসাব করেছে বিশ্বব্যাংক। সেই হিসাব অনুযায়ী জলদস্যুরা ক্রুদের জিম্মি করে সাড়ে তিনশো থেকে সোয়া চারশো মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ আদায় করেছে।


২০১১ সালে একটি তেলের ট্যাংকার জব্দ করে দস্যুরা। দু-শো মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের জ্বালানি ছিল নৌযানটিতে। আটক দুই ফিলিপিনো ক্রুকে হত্যা করা হয়।


যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ওশেন বিয়ন্ড পাইরেসির প্রতিবেদন বলছে, সাগরে দস্যুতার কারণে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে সাত থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার।


দস্যুদের সঙ্গে পেরে ওঠা যায় না কেন?


জাহাজের মালিকদের লুকআউট বা দ্রুতগতিতে ভ্রমণের মতো পরামর্শ দিয়ে থাকে আইএমবি। যাতে জলদস্যুরা তাদের ধরতে না পারে। কিন্তু, জলদস্যুরাও ঝটিকা আক্রমণ চালায়। প্রায়শই রাতের অন্ধকারে হাজির হয় তারা। তাই, ক্রুরা ঘটনা বুঝে উঠতেই দেরি হয়ে যায়। একবার জলদস্যুরা কোনো জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলে, সামরিক পদক্ষেপ নেয়া কঠিন হয়। কারণ, তাতে জিম্মিদের হতাহত হওয়ার শংকা বাড়ে। গভীর সমুদ্রে আটক জলদস্যুদের বিচারের মুখোমুখি করতে জটিলতার কারণে কখনো কখনো ছেড়েও দেওয়া হতো। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি রেজুলেশন আছে যাতে নিরাপত্তায় নিয়োজিত দেশগুলোকে সোমালি জলসীমায় দস্যুদের ধরার অনুমতির কথা বলা আছে।


বাংলাদেশি জাহাজ জিম্মি



সোমালিয়ার জলদস্যুরা ১২ মার্চ ২০২৪ বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ জিম্মি করে। জাহাজটি মোজাম্বিক থেকে দুবাই যাচ্ছিল। চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের এই জাহাজটি পরিচালনা করছে গ্রুপটির সহযোগী সংস্থা এস আর শিপিং লিমিটেড। জাহাজে ২৩ জন বাংলাদেশি নাবিক রয়েছেন।


এর আগে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর একই গ্রুপের জাহাজ ‘এমভি জাহান মনি’ ছিনতাই করেছিল সোমালিয়ার জলদস্যুরা। তিন মাসের মাথায় মুক্তিপণ দিয়ে জাহাজটি ছাড়িয়ে এনেছিল কবির গ্রুপ।


বিবার্তা/এমজে

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com