শিরোনাম
বাড়ছে অসহিষ্ণুতা : কোন পথে ভারত?‌
প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০১৭, ১৫:২৫
বাড়ছে অসহিষ্ণুতা : কোন পথে ভারত?‌
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

ভারত নামের দেশটিতে গরু-‌রক্ষার নামে অনেক মানুষকে খুন করা হয়েছে। মতের মিল না হলেই দেয়া হচ্ছে হুমকি। কোপ পড়েছে পাঠ্যপুস্তকে। রবীন্দ্রনাথ থেকে মির্জা গালিবের মতো অনেক বরেণ্য কবি-লেখকের রচনা পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। লেখক-সাংবাদিকদের কলম স্তব্ধ করতে ব্যবহার হচ্ছে বুলেট। সব মিলিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, কোন দিকে এগোচ্ছে ভারত? জবাব খুঁজেছে জার্মান বেতার ডয়চে ভেলে।


একদিকে দেশের বিদ্যালয়গুলোর পাঠক্রম থেকে ইংরেজি, উর্দু, আরবি শব্দ, রবীন্দ্রনাথের কবিতা, শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের উদ্ধৃতি, মির্জা গালিবের রচনা সবই বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ‘‌শিক্ষা সংস্কৃতি উত্থান ন্যাস'‌, সেই সঙ্গে গুজরাট আর শিখ দাঙ্গার প্রসঙ্গও ছেঁটে ফেলারও সুপারিশ করা হয়েছে। ওসব পড়লে নাকি ছাত্রছাত্রীদের চরিত্র ‘‌খারাপ’ হয়ে যেতে পারে!‌


এখানেই থেমে নেই ওরা। ‘‌বন্দে মাতরম’ নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। হিন্দি পাঠ্যবই থেকে ভাইস চ্যান্সেলর, ওয়ার্কার, ব্যাকবোন, রয়্যাল অ্যাকাডেমি, বেতরিব, তাকৎ, ঈমান, মেহমান-নওয়াজি ও ইলাকার মতো বেশ কিছু অ-হিন্দি শব্দ সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। পরিবর্তে ইতিহাস বইগুলোতে ছত্রপতি শিবাজীকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের অধীন এন সি আর টি-র কাছে পাঠানো তাদের সুপারিশে এ-‌ও বলা হয়েছিল যে, ‘‘‌যেভাবে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা উদ্ধৃত করে জাতীয়তাবাদ ও মানবতাকে দু'টি পরস্পরবিরোধী মত বলে দেখানো হয়েছে, সেটা অনুচিত।'’


উত্তরপ্রদেশে ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক থেকে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের অনন্য সৃষ্টি তাজমহলও বাদ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সুপারিশগুলো সামনে আসার সঙ্গেসঙ্গে প্রবল সমালোচনার ঢেউ আছড়ে পড়েছে ভারতজুড়ে।


বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এমন অসংখ্য অপচেষ্টা দেখা গেছে।


এদিকে ভারতে ইদানিং প্রায়শই সহিংসতার শিকার হচ্ছেন সংখ্যালঘুরা। উত্তরপ্রদেশের দাদরি হোক বা গুরাটের উনা, সর্বত্র একটি বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের (মুসলিম) ওপর ক্রমাগত চলছে হামলা। এর জন্য কি অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি দায়ী, নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?‌ প্রশ্নটা প্রবল হয়ে উঠছে ভারতে।


দিল্লি হাইকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতির‌ কথায়, ‘‌‘‌নাহ, অসহিষ্ণুতা নয়, বরং তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। ‌২০১৪ সালে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংখ্যালঘুদের মনে ভয় ছিলই, এখন সেই ভয় আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ, উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছে যোগী আদিত্যনাথকে। এ নিয়োগের পেছনে স্পষ্ট হাত রয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টির ‘মেন্টর’ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের। মনে রাখতে হবে, শাসক দলে নরেন্দ্র মোদীই একমাত্র মুখ। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থেকে এখন তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে প্রগতি-‌পুরুষ হিসেবে তুলে ধরার জন্য শিল্পপতিদের ধন্যবাদ। মুসলিমসহ সংখ্যালঘুদের ওপর ঘটে চলা হিংসাত্মক অপরাধ রুখতে মুখ খোলারও সাহস হবে না তাঁর।’’


উপরের কথাগুলো যিনি বলছিলেন তিনি আর কেউ নন, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রাজিন্দর সাচার, যাঁর নেতৃত্বাধীন ‘‌সাচার কমিটি’ ভারতে মুসলমানদের আর্থ-‌সামাজিক ও শিক্ষাগত অবস্থানের ওপর সমীক্ষা করে রিপোর্ট জমা দিয়েছিল। সাচার কমিটির রিপোর্টের এক দশক পরে বিজেপি ‌সরকার এখন নতুন করে মুসলিমদের আর্থ-‌সামাজিক ও শিক্ষাগত অবস্থান জানতে নতুন কমিটি গড়ার কথা ভাবছে।


এদিকে শাসক দলের একাধিক নেতা, এমনকি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিংয়ের মতো মন্ত্রীও মুসলমানদের সংখ্যালঘু তালিকা থেকে বাদ দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। বলা হচ্ছে, ‘‌‘‌এ দেশে মুসলিমদের জনসংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, ফলে তারা আর সংখ্যালঘু নয়।'’ অথচ সাচার কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ৷, যেখানে হিন্দুদের সংখ্যা ৮০ শতাংশ। আরও একটি তথ্য হলো, গত এক দশকে ভারতে হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর তুলনায় মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কিছুটা হলেও কম।

তবে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ‌রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী মনে করছেন, ‌আগামী নির্বাচনে বিজেপি আর একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসতে পারবস্টহত। ফলে, হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার প্রশ্ন নেহাতই অমূলক। তিনি মনে করেন, ভারতে এখনো একনায়কতন্ত্রের কোনও স্থান নেই। সবাইকে নিয়ে চলতেই হবে। তাই আরএসএসের যতই চাপ থাক না কেন, দেশ শাসন করতে হলে মধ্যপন্থা বেছে নিতে বাধ্য হবেন প্রধানমন্ত্রী। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের মতো বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলির নির্বাচনে বিজেপি মোটেই ভালো ফল করবে না। তাই প্রধানমন্ত্রীসহ তাঁর দলের নেতারা বাইরে যতই কর্তৃত্ব দেখাক না কেন, রাজনৈতিকভাবে সেই কর্তৃত্ব থাকবে কিনা সন্দেহ আছে। তাছাড়া ভারতের ইতিহাস বলছে, এই দেশ কখনোই কোনো বিষয়ে চরমপন্থী বা আগ্রাসীদের গ্রহন করেনি। ফলে, চিন্তা-‌ভাবনা পর্যন্ত ঠিক আছে, উদ্যোগী হলেই বাধা পেতে হবে।


‌‌অনেকেই মনে করছেন, বিজেপি ২০১৯-‌এর নির্বাচন জয় করতে পারলেই ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করার পথে আর কোনো বাধা থাকবে না। সেরকম কিছু ঘটলে সেটা হবে ভারতের গণতন্ত্র ও সংবিধানের ক্ষেত্রে আত্মহননের সমতুল্য। সংসদীয় গণতন্ত্রে সক্রিয় ও শক্ত বিরোধী থাকা অত্যন্ত জরুরি। এই অবস্থায় বিপদ আঁচ করতে না-পারা বিরোধীদের ঘুম ভাঙাবে কে?‌ জাতীয় স্তরে বিজেপি‌বিরোধী জোট গড়তে হবে বিরোধীদের। তা না পারলে ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণ জনতার কাছে চূড়ান্ত অসৎ ও ধান্দাবাজ বলে প্রমাণিত হবে বিরোধীরা।


‌প্রশ্ন উঠেছে বিরোধীদের একজোট হওয়া নিয়ে। বিরোধীদের প্রধান মুখ বলতে এই মুহূর্তে কংগ্রেস সহ‌সভাপতি রাহুল গান্ধী। কিন্তু মোদি ম্যাজিকের কাছে পাত্তাই পাচ্ছেন না তিনি। তাঁর বক্তৃতায় ধার-‌ভার কিছুই খুঁজে পান না শ্রোতারা। পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম ও তৃণমূল উভয়েই বিজেপিবিরোধী। উত্তরপ্রদেশে দু'টি বড় দল সমাজবাদী পার্টি এবং বহুজন সমাজ পার্টিও তা-ই। একই ছবি অন্যান্য রাজ্যেও। কংগ্রেস, আরজেডি, বিজেডি, এনসিপি, ডিএমকে‌র মতো দলগুলো ছন্নছাড়া। এক ছাতার তলায় আসতে তাই হোঁচট খাবেন নেতারা।


বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com