শিরোনাম
ক্যানসারের কারণ হিসেবে স্থুলতা কতটা দায়ী?
প্রকাশ : ০৪ জুলাই ২০১৯, ১৪:৩৮
ক্যানসারের কারণ হিসেবে স্থুলতা কতটা দায়ী?
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

ক্যানসার একটি জটিল মারাত্মক রোগ। এটি শরীরের যেকোনো অঙ্গে হতে পারে। এটি টিউমার অথবা অদৃশ্য রক্তের শ্বেতকণিকা হতে পারে। ক্যানসার একটি মাত্র কোষ থেকে সৃষ্টি হয়। সাধারণত জিনগত ও পরিবেশগত কারণে ক্যানসার হয়।


প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসারের কোনো উপসর্গ থাকে না। হঠাৎ একদিন ছোট্ট কোনো উপসর্গ থেকেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দুঃসংবাদটা জানা যায়।


স্থূলতা এবং ক্যানসারের মধ্যে সম্পর্ক পরিষ্কারভাবে উঠে এলেও এর পেছনে কি ধরণের জৈবিক প্রক্রিয়া কাজ করছে তা এখনো সম্পূর্ণভাবে ধারণা করা যায়নি।


ব্রিটেনে এখন সাধারণ চার ধরনের ক্যানসারে অনেক ক্ষেত্রে ধূমপানের চেয়ে বড় কারণ হয়ে উঠেছে স্থূলতা। এমনটাই বলছে দাতব্য সংস্থা ক্যানসার রিসার্চ ইউকে।


তারা জানিয়েছে, অন্ত্র, কিডনি, ওভারিয়ান এবং লিভার ক্যান্সারের কারণ যতটা না তামাকের ধূমপান থেকে হচ্ছে তার থেকে বেশি হচ্ছে অতিরিক্ত ওজনের কারণে।


তারা আরও জানান, লাখ লাখ মানুষ ক্যান্সারের ঝুঁকিতে আছে তাদের ওজনের কারণে। এবং এসব মোটা মানুষদের ক্যানসারের আশঙ্কা ধূমপায়ীদেরকেও ছাড়িয়ে গেছে।


কিন্তু ওবেসিটির ফলে ক্যানসার ঝুঁকির বিষয়টি নিয়ে এর নতুন বিলবোর্ড ক্যাম্পেইন নিয়ে তারা সমালোচনার মুখে পড়েছে। সেখানে ফ্যাট-শেমিং বা শারীরিক স্থূলতা নিয়ে অসম্মানজনক বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য সমালোচনার মুখে পড়েছে তারা।


তবে এই অভিযোগে এই দাতব্য সংস্থাটি এই প্রথমবার অভিযুক্ত হল তেমনটি নয়।


গত ফেব্রুয়ারিতেই কমেডিয়ান এবং ক্যাম্পেইনার সোফি হাগেন এই ক্যাম্পেইনের সমালোচনার জন্য টুইটারকে বেছে নেন।


ক্যানসার রিসার্চ ইউকে বলেছে যে, তারা ওভার-ওয়েট বা মেদবহুল হওয়ার জন্য লোকজনকে দোষারোপ করছে না। আবার ক্যানসারের জন্য ক্ষতিকরের দিক বিবেচনায় ধূমপান এবং স্থূলতা সরাসরি তুলনীয় বলে তারা উল্লেখ করছে না, তবে দুটোই ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।


কিন্তু তারা বলেছে, অতিরিক্ত ওজনের অধিকারী বা স্থুল হওয়ায় প্রতিবছর প্রায় ২২ হাজার ৮০০ ক্যানসারের ঘটনা ঘটছে, আর ধূমপানের কারণে ঘটছে ৫৪ হাজার ৩০০ ঘটনা।


স্থূলতা এবং ধূমপানের কারণে যে চারটি ক্যান্সারের ঘটনা সচরাচর ঘটছে-


অন্ত্র: প্রায় ৪২ হাজার নতুন ক্যানসারের ঘটনা যার মধ্যে ওভারওয়েট বা স্থূলতার কারণে ৪,৮০০ এবং ধূমপানের কারণে ২৯০০টি।


কিডনি: সর্বমোট ১২ হাজার ৯০০ ক্যান্সার আক্রান্তের মধ্যে অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতার কারণে ২৯০০ এবং ধূমপানের কারণে ১৬০০ জন আক্রান্ত।


লিভার: সর্বমোট ৫৯০০ জনের মধ্যে অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতার জন্য ১৩০০ এবং ধূমপানের জন্য ১২০০ জন আক্রান্ত।


ওভারিয়ান: মোট ৭,৫০০ জন আক্রান্ত এবং প্রতিবছর অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা ৪৯০ জনের ক্যান্সারের জন্য দায়ী, যেখানে ধূমপান দায়ী ২৫ জনের ক্ষেত্রে।


সার্বিকভাবে ব্রিটেনে ক্যান্সারের প্রতিরোধ-যোগ্য কারণগুলোর মধ্যে ধূমপান প্রধান। এর পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ওবেসিটি-বলছে সিআরইউকে।


কিন্তু যেসময়টাতে ধূমপানের হার কমে আসছে, তখন ওবেসিটি বা স্থূলতা বাড়ছে, যেটাকে স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন।


সে কারণে টোরি নেতা বরিস জনসন পর্যালোচনা ছাড়া সুগার ট্যাক্স বর্ধিত না করার ঘোষণা দিলে তাদের পক্ষ থেকে সেই সতর্কবার্তা আসে।


কোমল পানীয় থেকে মিল্কশেক-এর ওপর ট্যাক্স বর্ধিত করার পরিকল্পনা বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে, মিস্টার জনসন নিজের ওজন নিয়ে কৌতুক করে বলেছিলেন, ট্যাক্স আরোপ করায় অন্তত যারা এটা বহন করার সামর্থ্য রাখেন তাদের আহত করতে তিনি ‘খুব খুব অনিচ্ছুক’ ছিলেন।


তিনি পরামর্শ দেন, ‘আমরা লোকজনে হাটতে, সাইকেল চালাতে এবং সাধারণত আরও বেশি ব্যায়াম করতে উৎসাহিত করছি’।


যুক্তরাজ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ স্থুল।


ব্রিটেনের এ সম্পর্কিত আরও যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ:


১৩.৪ মিলিয়ন স্থুল প্রাপ্তবয়স্ক আছে যারা ধূমপান করে না।


৬.৩ মিলিয়ন প্রাপ্ত বয়স্ক ধূমপায়ী রয়েছে যারা স্থুল নয়।


১.৫ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি যারা একইসঙ্গে স্থুল এবং ধূমপায়ী।


স্থুলতা এবং ক্যানসারের মধ্যে সম্পর্ক পরিষ্কারভাবে উঠে এলেও, এর পেছনে কি ধরণের জৈবিক প্রক্রিয়া কাজ করছে তা এখনো সম্পূর্ণভাবে ধারণা করা যায়নি।


চর্বি কোষ অতিরিক্ত হরমোন তৈরি করে এবং বৃদ্ধি করে যা কোষগুলোকে বিভক্ত হয়ে পড়তে বলে। এটা ক্যানসার কোষ তৈরি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।


শারীরিক সক্রিয়তা বা কর্মশক্তি হয়তো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।


মোটা হলে বা অতিরিক্ত ওজনের অধিকারী হলেই যে একজন মানুষের নিশ্চিতভাবে ক্যান্সার হবে তেমনটা নয়, কিন্তু সেটা ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়। এবং এই ঝুঁকি বেড়ে যায় যখন সে আরও বেশি ওজন লাভ করে এবং যত দীর্ঘসময় ধরে সে অতিরিক্ত শারীরিক ওজন বহন করে চলে।


ক্যানসার রিসার্চ ইউকে'র তথ্য অনুসারে ১৩টি ভিন্ন ভিন্ন ক্যানসার স্থূলতার সাথে সম্পর্কিত। সেগুলো হলো:


স্তন ক্যানসার (মেয়েদের মেনোপজের পরে)


অন্ত্রের ক্যানসার, প্যানক্রিয়াটিক বা অগ্নাশয় ক্যানসার


খাদ্যনালীর ক্যানসার


লিভার ক্যানসার


কিডনি ক্যানসার


পাকস্থলীর উপরের অংশ,


গল-ব্লাডার


জরায়ু


ওভারিয়ান বা ডিম্বাশয়


থাইরয়েড


ব্লাড ক্যান্সার


মস্তিষ্কের ক্যানসার।


স্থূলতা ও ক্যানসারের এই সম্পর্ক যদিও শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে দেখা গেছে, তবে স্বাস্থ্যসম্মত আদর্শ ওজন শিশুদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।


এই দাতব্য সংস্থাটি বলেছে, প্রতিবছর ব্রিটেনে অতিরিক্ত ওজনের ফলে যা ঘটে:


ধূমপানের চেয়ে ১৯০০-র বেশি অন্ত্রের ক্যানসার


১৪০০-র বেশি কিডনির ক্যানসার


৪৬০-র বেশি ওভারিয়ান ক্যানসার


১৮০-র বেশি লিভার ক্যানসার।


দেশটির ওবেসিটি সমস্যাকে আরও কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার জন্য সরকারের উচিত উদ্যোগ নেয়া, এমনটাই মনে করছেন ক্যান্সার রিসার্চ ইউকে-র বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক লিন্ডা বোল্ড।


ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, অস্বাস্থ্যকর খাবার এবং পানীয়ের বিজ্ঞাপন সীমিত করার ক্ষেত্রে সরকার ধীর গতিতে এগুচ্ছে।


তারা বলেছে, ‘আমরা ধূমপানের সাথে সম্পর্কিত স্বাস্থ্য ঝুঁকির ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন হলেও, ওবেসিটি মোকাবেলায় উদ্যোগ কম নেয়া হয়েছে, যেটা এখন ক্যান্সারের প্রধান একটি কারণ’।


এনএইচএস ইংল্যান্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাইমন সিভেন্স বলেছেন, স্থুলকায়তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এনএইচএস একা জয়ী হতে পারবে না।


‘আমেরিকার ক্ষতিকর এবং ব্যয়বহুল উদাহরণ সামনে রেখে যদি আমরা তা এড়াতে চাই,তাহলে বিভিন্ন পরিবার, খাদ্য ব্যবসায়ী এবং সরকার-সবাইকে তাদের নিজেদের যার যার অবস্থানে থেকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে’। সূত্র: বিবিসি


ক্যানসার ঠেকাতে যা করবেন


নিজে ক্যানসারের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তা জানা জরুরি। ক্যানসারের কোনো চিহ্ন নেই, উপসর্গ নেই কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের মাঝেমধ্যে বিভিন্ন পরীক্ষা করানো উচিত। এতে প্রায়ই রোগ জটিল হওয়ার আগেই ধরা পড়ে। যেমন:


• নারীদের জরায়ুমুখ ক্যানসার স্ক্রিনিং ক্যানসার প্রতিরোধের একটি সফল উদাহরণ। বিয়ের তিন বছর পর থেকে (২১ বছরের আগে নয়) ৬৪ বছর বয়স পর্যন্ত তিন বছর পরপর পেপস টেস্ট এবং ভায়া টেস্ট করানো উচিত।


• বিশ বছর বয়স থেকে নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করতে শেখা। ২০ থেকে ৩৯ বছর বয়স পর্যন্ত তিন বছরে একবার এবং ৪০ বছর হলে বছরে একবার চিকিৎসকের মাধ্যমে পরীক্ষা করানো।


• ১৫-৪৫ বছর বয়সী পুরুষেরা প্রতি মাসে গোসলের সময় নিজের অণ্ডকোষ নিজে পরীক্ষা করে দেখা।


• প্রতি মাসে একবার দাঁত ব্রাশ করার সময় নিজের মুখ ও মুখগহ্বর নিজে আয়না দিয়ে পরীক্ষা করা।


• বছরে দুবার দন্তচিকিৎসকের কাছে মুখ পরীক্ষা করানো।


• প্রতি মাসে দেহের কোথাও তিল বা আঁচিল থাকলে নিজে পরীক্ষা করা।


• বয়স পঞ্চাশ বছর হলে কোলন ক্যানসারের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া।


কখন সতর্ক হবেন


ঝুঁকি থাকুক আর না থাকুক, কিছু কিছু উপসর্গ অবহেলা না করাই উচিত। যেমন: আকস্মিক ওজন কমা, হঠাৎ রক্তশূন্যতা, চল্লিশের পর হঠাৎ ভীষণ অরুচি, স্তন বা যেকোনো জায়গায় কোনো গোটা বা দানা বুঝতে পারা, মুখের ভেতর দীর্ঘমেয়াদি ঘা, এক মাসের বেশি কাশি, কফের সঙ্গে রক্ত, কণ্ঠস্বরের আকস্মিক পরিবর্তন, মলের সঙ্গে রক্তপাত, কালো রঙের পায়খানা ইত্যাদি কিছু উপসর্গ সব সময়ই সন্দেহজনক। এসব ক্ষেত্রে দেরি না করে সমস্যা শনাক্ত করা দরকার।


বিবার্তা/শারমিন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com