শিরোনাম
সবকিছুতেই যখন দুর্গন্ধ
প্রকাশ : ২৮ মার্চ ২০১৭, ২১:১২
সবকিছুতেই যখন দুর্গন্ধ
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

আমাদের শরীরে কতো বিস্ময়কর জিনিসই না ঘটে! একেকটি ঘটনা একেক রকমের। তার কিছুটা আমরা জানি আর অনেকটাই অজানা।


এরকমই রহস্যময় কিছু শারীরিক ঘটনা নিয়ে গবেষণা করছেন ব্রিটেনের একজন চিকিৎসক ড. গ্যাব্রিয়েল ওয়েস্টন। এটা করতে গিয়ে নতুন নতুন নতুন শারীরিক রহস্যও আবিষ্কার করছেন তিনি। এরকমই একটি চমকপ্রদ গল্প :


লুইজ ওলাম একজন সাংবাদিক ও লেখক। মূলত পারফিউম বা সুগন্ধি নিয়েই তিনি লেখালেখি করেন। বহু পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি।


দু'বছর আগে একবার তার খুব ঠাণ্ডা লেগেছিলো। তারপরেই গন্ধ নেয়ার ক্ষমতা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেন লুইজ ওলাম। কোনো রকম গন্ধই পাচ্ছিলেন না তিনি - না সুগন্ধ, না দুর্গন্ধ। এমনকি ধীরে ধীরে এবং খুব জোরে শ্বাস নিয়েও তিনি কোনো কিছুর গন্ধ পাচ্ছিলেন না।


এধরনের ঘটনা আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই মাঝে-মধ্যে হয়ে থাকে। পরে যখন ঠাণ্ডাটা চলে যায় তখন সাধারণত সেটা ঠিকও হয়ে যায়। কিন্তু লুইজের বেলায় সেরকম হলো না।


তিনি বলেন, "একসময় আমার ঠাণ্ডাটা সেরে গেলো। এর কিছু দিন পর একদিন আমি একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম যেখানে নতুন একটি পারফিউম বাজারে ছাড়া হচ্ছিলো। সেদিন আমি স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারলাম যে আমি আসলে কোনো কিছুরই গন্ধ নিতে পারছি না। তখন আমি খুব বড় রকমের দুশ্চিন্তার ভেতরে পড়ে গেলাম।"


কিন্তু তারপর এমন একটি ঘটনা ঘটলো, যা কারো কল্পনাতেও ছিলো না। সুখবর - লুইজ গন্ধ পেতে শুরু করলেন। ফিরে আসতে শুরু করলো তার গন্ধ পাওয়ার ক্ষমতা।


কিন্তু সেটা আসলে সুখবর ছিলো না। হয়ে গেলো বড়ো রকমের দুঃসংবাদ। লুইজের যে ধরনের গন্ধ পাওয়ার কথা ছিলো তিনি সেরকম গন্ধ পাচ্ছিলেন না। তিনি বলেন, "আমি যে জিনিসেরই গন্ধ নিচ্ছি সেটাই হয়ে উঠলো খুব খারাপ গন্ধ। আগে আমি যেমন সুগন্ধ ও দুর্গন্ধের মধ্যে পার্থক্য করতে পারতাম এখন আর সেরকমটা পারছি না। সবকিছুতেই খারাপ গন্ধ পেতে শুরু করলাম।"


তিনি আরো বলেন, "আমার চারপাশে যখনই কিছুর গন্ধ শুঁকি, মনে হয় পোড়া গন্ধ। পেঁয়াজ পচে গেলে কিম্বা মাংস পোড়ানো হলে যে রকম গন্ধ পাওয়া যায়, সেই রকম গন্ধ। একসময় আমার মনে হচ্ছিলো আমি হয়তো পাগল হয়ে যাবো। এর চেয়েও খারাপ বিষয় হলো, যেটারই খারাপ গন্ধ পাচ্ছিলাম সেটার স্বাদও হয়ে উঠলো ওই খারাপ গন্ধের মতো। নানা রকমের বাজে গন্ধ - রাসায়নিক পদার্থের, পেট্রোলের গন্ধ। কলা খেতে চাইলে তার গন্ধ হয়তো হয়ে উঠলো পেট্রোলের গন্ধের মতো। কলার স্বাদও হয়ে উঠলো সেরকম। চকলেট, বিস্কিট এসবে কামড় দিলো মনে হতো পোড়া পাতার গন্ধ পাচ্ছি। সবকিছুর গন্ধ স্বাদ বদলে গেলো। একদিন রবিবার আমার মা আমার জন্যে দুপুরের খাবার রান্না করলো। কিন্তু আমি যখন খেতে গেলাম, মনে হলো এগুলোর ওপরে যেনো মল-মূত্রের মতো বর্জ্য ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে।


শরীরের এই অবস্থাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় পোরোজমিয়া।


বেঁচে থাকার জন্যে আমাদের এই গন্ধ নেওয়ার ক্ষমতাটা খুবই জরুরী। চারপাশের বিশ্বকেও আমরা এর মাধ্যমে বুঝতে পারি। কিন্তু এর গুরুত্ব আমরা ঠিক সেভাবে বুঝতে পারি না।


যাহোক, একসময় দুর্বিষহ হয়ে উঠলো লুইজের জীবন। তিনি বলছিলেন, মানুষ বুঝতেও পারে না এই গন্ধ নিতে পারার ক্ষমতা মানুষের জীবনে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাত্যহিক জীবনের ওপর এর কি ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।


তার মানে লুইজের শরীরে কোনো একটা বিপর্যয় ঘটেছে। তার নাক ও মস্তিষ্কের মধ্যে যে সম্পর্ক সেখানে তৈরি হয়েছে বড়ো ধরনের সমস্যা। বিজ্ঞানীরা ধারণা করলেন, লুইজের মস্তিষ্কের ভেতরে এই প্রক্রিয়াতে কোথাও কোনো গণ্ডগোল হয়েছে


এখন দেখা যাক কিভাবে আমরা কোন কিছুর গন্ধ পাই :


আমরা যখন কিছুর গন্ধ নিই তখন বাতাস থেকে কিছু অণু নাকের মাধ্যমে ভেতরে টেনে নিই। এসব অণুর মধ্যে থাকে গন্ধ।


আমাদের নাকের ভেতরে গোড়ার দিকে কিছু রিসেপ্টর বা গ্রহীতা থাকে, যেগুলো এসব গন্ধকে বুঝতে পারে।


এই রিসেপ্টরগুলো যুক্ত থাকে আমাদের মস্তিষ্কের ফ্যাক্টরি নার্ভের সাথে। তারপর সেই স্নায়ু কিছু বাল্বের মাধ্যমে বার্তা পাঠায় মস্তিষ্কের খুব গভীরে। সেখানে যেসব স্নায়ু আছে সেগুলোই আমাদেরকে দেয় গন্ধের ধারণা।


বিজ্ঞানীরা ধারণা করলেন, লুইজের মস্তিষ্কের ভেতরে এই প্রক্রিয়ায় কোথাও কোনো গণ্ডগোল হয়েছে।


এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন ক্রিস কেলি। লুইজের মতো তারও একবার এধরনের সমস্যা হয়েছিলো। তিনিও হারিয়ে ফেলেছিলেন গন্ধ নেয়ার ক্ষমতা। তারপর থেকে কয়েক বছর ধরে তিনি এই বিষয়ে গবেষণা করেছেন।


শরীরের এই ত্রুটি কি ধরনের সমস্যা সেটি ব্যাখ্যা করছিলেন ক্রিস কেলি। তিনি বলেন, "আমি এটাকে কল্পনা করি একটি টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মতো, যেখানে অগণিত তার এদিকে-ওদিকে পেঁচানো অবস্থায় রয়েছে। নাকের সাথে মস্তিষ্কের যে যোগাযোগ সেটাও অনেকটা এরকমই। কেউ যখন গন্ধ নেয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তার অর্থ হলো টেলিফোন এক্সচেঞ্জের তারগুলো টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। সেগুলো মাটিতে পড়ে আছে। তারপর সময় পার হওয়ার সাথে সাথে কিছু ঘটনা ঘটলো। কিছু কিছু তার মাটি থেকে উঠে দাঁড়ালো এবং এদিকে-ওদিকে বিভিন্ন সকেটে এলোপাথাড়িভাবে লেগেও গেলো। ফলে এসব তার দিয়ে আপনি যেসব তথ্য পাচ্ছিলেন সেগুলো সব এলোমেলো হয়ে উঠলো। টেলিফোন এক্সচেঞ্জের ভেতরে তৈরি হলো চরম বিশৃঙ্খলা। যেখানে যে তথ্য পাওয়ার কথা সেখানে সেই তথ্য পাওয়া গেলো না। কারণ সেখানে সংযোগগুলো ঠিক ছিলো না।


লুইজের নাক ও মস্তিষ্কের স্নায়ুর মধ্যেও ঠিক একই ধরনের ঘটনা ঘটলো। তার মস্তিষ্কে যেসব তথ্য যাচ্ছে সেগুলো তিনি ঠিকমতো বুঝতে পারছেন না। কারণ ভুল সংযোগের কারণে বার্তা বা সঙ্কেত সবকিছু এলোমেলো হয়ে পড়েছে।


এ অবস্থায় ক্রিস কেলির সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ালো এসব বার্তাকে ঠিকমতো পড়তে পারার ব্যবস্থা করা। গন্ধকে যেনো লুইজ আবার ঠিকমতো চিনতে পারে সেজন্যে তার মস্তিষ্ককে প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ নিলেন ক্রিস কেলি।


এই প্রশিক্ষণ খুব সহজ। এখানে যেটা করতে হবে তা হলো আপনার মস্তিষ্ককে ঠিকমতো কাজে লাগাতে হবে। এই প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে আপনি স্নায়ুর নতুন নতুন পথ তৈরি করছেন।


প্রত্যেকদিনই আপনাকে এই চর্চাটা করতে হবে। কোনো কিছুর গন্ধ নেয়ার সময় মস্তিষ্ককে বার্তা দিতে হবে যে এটা এই জিনিস, এর গন্ধ হবে এরকম ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা অনেকটা ফিজিওথেরাপির মতো।


যাদেরই এধরনের সমস্যা হয়েছে এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে সাহায্য করতে শুরু করলেন ক্রিস কেলি। চিকিৎসা করতে গেলেন লুইজ ওলামকেও।


তিনি বলেন,"লুইজের পোরোজমিয়া ছিলো ভয়াবহ। অনেকের ক্ষেত্রেই এই খারাপ গন্ধটা দূর করা খুব কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার সবচে ভালো উপায় হচ্ছে, প্রতিদিন প্রতিটা মুহূর্তে নিজের মস্তিষ্কে এই বার্তা দেয়া যে এটা এই জিনিস আর এর গন্ধ এরকম।


এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আবারও সুগন্ধ ফিরে পাওয়া অনেকটাই সম্ভব হতে পারে।


গন্ধ নেওয়ার এই প্রশিক্ষণ, এটা পোরোজমিয়ার কোনো চিকিৎসা নয়। তবে এখান থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খুব পরিষ্কার যে, আমরা যখন গন্ধ নেয়ার ক্ষমতা হারাই, তার মানে হলো আমাদের মাথার অনেক ফ্যাক্টরি নার্ভ বা স্নায়ু নষ্ট হয়ে গেছে। তখন ফ্যাক্টরি বাল্বগুলো চুপসে যায়।


কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই বাল্বগুলোকে আবারও উদ্দীপ্ত করার মাধ্যমে সক্রিয় করে তোলা সম্ভব।


লুইজ ওলাম এরকম প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বহু গন্ধই পুনরায় ফিরে পেয়েছেন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ধীরে ধীরে আরো বহু সুগন্ধই আগামীতে ফিরে আসবে তার মস্তিষ্কে। সূত্র : বিবিসি


বিবার্তা/হুমায়ুন/কাফী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com