দালালের খপ্পরে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল, ভুক্তভোগী রোগীরা!
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৩, ১১:১৩
দালালের খপ্পরে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল, ভুক্তভোগী রোগীরা!
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

লাইনের পর লাইন, সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে মানুষ। দেখে মনে হবে, সভা কিংবা সমাবেশ চলছে, আবার কেউ মনে করতে পারে এটি বিনোদন কেন্দ্র। আসলে, যে জায়গার কথা বলছি সেখানে বিনোদনের জন্য কেউ যায়নি বা সভা-সমাবেশও নয়। মূলত নিজেদের চিকিৎসা করাতেই সেখানে লোক সমাগম। কিন্তু এসে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে যেন তাদের রোগ আরও বেড়ে যাওয়ার উপক্রম।


তাদের অনেকে আবার ক্লান্ত হতে হতে লাইনে বসেও পড়েছেন। কেউবা আবার হাঁফাতে হাঁফাতে নিজের দীর্ঘশ্বাস ফেলে অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন। তবুও অনেকের সিরিয়াল এগিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখাতে না পারার আক্ষেপ। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটনাও ঘটছে। কেউ কেউ সিরিয়ালে পরে আসলেও ডাক্তারের দেখা কিন্তু ঠিকই আগে পেয়ে যাচ্ছেন। এই বিষয়ে ভুক্তভোগী রোগীরা বলছেন, আনসারসহ ডাক্তারের সাথে কাজ করা লোকজন অবৈধ পন্থায় টাকা নিয়ে এই কাজ করছে। ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি টাকা না দিলে যেন শেষ হচ্ছে না!



বলছি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। এই হাসপাতালটির বহির্বিভাগ ১ ও বহির্বিভাগ ২-এ সরেজমিনে গিয়ে জনসাধারণের দুর্বিষহ এই চিত্র দেখা যায়। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি আর দালালদের খপ্পরের দৃশ্যই যেন এখানকার প্রতিদিনকার ঘটনা।


সরেজমিনে দেখা যায়, বহির্বিভাগ ১-এ সাধারণ মানুষ মেডিসিনের ডাক্তার দেখাতে সকাল ৭ টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। এরপর যত বেলা গড়াতে থাকে আউটডোরের প্রবেশপথ থেকে শুরু করে হাসপাতালের বিভিন্ন ফ্লোরে রোগী ও তাদের সঙ্গে অভিভাবক-স্বজনদের ভিড় ততই বাড়তে থাকে। এরপর বেলা ৮ টা থেকে দেয়া হয় টিকিট। মাত্র ৩০ টাকা মূল্যের এই টিকিট কেটে মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, শিশু বিভাগ ও সাব স্পেশালিটিসহ নানা বিভাগের ডাক্তার দেখিয়ে উন্নত চিকিৎসা লাভের সুযোগ পেতে এখানে ছুটে আসছেন হাজারো মানুষ। কম খরচ ও সেরা মানের চিকিৎসার বিষয় বিবেচনা করে এখানের নানা ভোগান্তি সহ্য করে চলেছেন সাধারণ মানুষ।


এদিকে বহির্বিভাগ ২-এ বহির্বিভাগ ১-এর তুলনায় ভোগান্তি কম হলেও সেখানে রিপোর্ট পাওয়াকে ঘিরে মানুষের ছোটাছুটির শেষ নেই। এখানে নয়, ওখানে যান, এখন নয়, পরে আসেনসহ আরও নানা কথা রোগী ও তাদের স্বজনদের শুনতে হচ্ছে।



বুধবার, ২৬ জুলাই সরেজমিনে আরো দেখা যায়, বহির্বিভাগ ১-এর দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগে যেন ভোগান্তির আরেক নাম। এখানে তীব্র গরমে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অধিকাংশ রোগী ও তাদের স্বজনরা হাঁপিয়ে উঠছেন। কিন্তু এরপরেও অর্থাৎ ঘণ্টার পর ঘণ্টা কষ্ট করেও অনেকে ডাক্তার দেখাতে পারছেন না বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী রোগীদের।


এখানে টানা ৪ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ঢাকার কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা আকবর হোসেন বিবার্তাকে বলেন, সকাল ৭ টায় হাসপাতালে এসেছি। এরপর টিকিট পেয়েছি ২ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ৯ টার দিকে। তারপর সেই টিকিট নিয়ে মেডিসিনের ডাক্তার দেখাতে গেলাম দ্বিতীয় তলায় কিন্তু সেখানেও আরও বড় লাইন। ৯ টার পর থেকে ১টা পর্যন্ত এখানে দাঁড়িয়ে থাকলেও এখনো আমি ডাক্তার দেখাতে পারিনি। তবে আমার সিরিয়াল এখন যেহেতু একটু সামনের দিকে আছে তখন কিছুক্ষণ পর হয়তো ডাক্তারের সাক্ষাতের সুযোগ পেতে পারি। তবে না দেখানোর আগ পর্যন্ত সেটাও নিশ্চিত হতে পারছি না।


অভিযোগ করে তিনি বলেন, সকাল থেকে দেখলাম, লাইন যেন হাঁটতেই চায় না! পরে আমরা বুঝলাম সামনের দিক দিয়ে সিন্ডিকেট করে টাকা নিয়ে লোক ঢুকানো হচ্ছে। তখন আমরা পেছনের লোক চিল্লাচিল্লি শুরু করলে বলা হচ্ছে বেশি অসুস্থ রোগী, ডাক্তারের আত্মীয়সহ নানা কথা। এখানে আনসারসহ ডাক্তারের রুমের সামনে অবস্থানকারী সহকারীরা এর সাথে জড়িত বলে জানান তিনি।


এই স্থানে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে লাইনের মধ্যে বসে পড়েছেন বয়স্ক গফুর মিয়া। তিনি বিবার্তাকে বলেন, মিরপুর থেকে এসেছেন চিকিৎসা নিতে। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে থাকার ভোগান্তি আর সহ্য করতে পারছেন না। তাই লাইনের মধ্যে বসে পড়েছেন, যাতে অন্য কেউ তার জায়গা দখল করতে না পারে। এরপর তিনি প্রতিবেদককে কামরুল নামের এক আনসার সদস্যের দিকে দেখিয়ে বলেন, তার পেছনের লোক এই আনসারকে ১০০ টাকা দিয়ে সিরিয়াল না মেনে সিস্টেম করে ডাক্তার দেখিয়ে চলে গেছে।



পরে এই বিষয়ে অভিযুক্ত আনসার কামরুলকে প্রতিবেদক অভিযোগের বিষয়টি অবগত করে বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বিবার্তাকে বলেন, এখানে কোন অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি হয় না। তবে কিছুটা ভোগান্তি আছে। এই কথা বলে তিনি সেখান থেকে অন্য দিকে চলে যান।


এদিকে মেডিসিন বিভাগের ২১৮ নম্বর রুমের সামনে নজরে পড়ল আরেক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। এখানে রাহেলা বেগম নামের এক স্ত্রী বসে আছেন ফ্লোরে আর তার স্বামী শুয়ে আছে তার পাশে। তিনি স্বামীকে একটু বাতাস করার জন্য আশেপাশে কিছু একটা খুঁজছেন। কিন্তু কিছু না পেয়ে নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে স্বামীর ঘাম মুছে দিচ্ছেন। পরে এই বিষয়ে প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় রাহেলা বেগমের। তিনি বিবার্তাকে বলেন, বড় ডাক্তার দেখাতে এই মেডিক্যালে আসছিলাম। কিন্তু লাইনে দাঁড়িয়ে আমার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই লাইন ছেড়ে দিয়ে একপাশে নিয়ে এসে এখানে শুইয়ে রেখেছি। বাবা- কত যে কষ্ট - বলে বোঝাতে পারবো না!


ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের ভোগান্তির বিষয়ে অবগত করে মন্তব্য জানতে চাইলে এই বিভাগের ডা. আশিক রহমান বিবার্তাকে বলেন, দেখুন, এখানে ভোগান্তি হয় সেটা আমরাও জানি। কিন্তু কী করবো বলেন? এত বেশি রোগী আসে, সামলানো মুশকিল।



আনসার ও ডাক্তারদের সহকারীদের অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা ডাক্তাররা তো রুমের ভিতরে থাকি। কাজেই বাহিরে এসব অনিয়ম হলে সেটা আমাদের পর্যবেক্ষণ করা দুঃসাধ্য বিষয়। তারপরেও খেয়াল রাখার চেষ্টা করবো।


মেডিসিন বিভাগের ডা. হারুন নামের আরেক চিকিৎসক বিবার্তাকে বলেন, রোগী দেখবো নাকি এসব অনিয়মের দিকে খেয়াল রাখবো, বলেন? তবে অনিয়ম কোনভাবেই কাম্য নয় বলে জানান তিনি।


বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালের হেল্প ডেস্ক জানায়, সকাল ৮ টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত সকালের টিকিট দেওয়া হচ্ছে, যার মূল্য ৩০ টাকা। আর দুপুর ২ টার পর স্পেশাল কেয়ারে রোগী দেখার টিকিট ২০০ টাকা, যা ৪ পর্যন্ত চলমান থাকে। এই টিকিটে সিরিয়াল নম্বর দেওয়া থাকলেও সকালের টিকিটে তার কিছুই থাকে না। ফলে এই শিফটের রোগীদের ভোগান্তি বেশি।


রোগীদের নানা ভোগান্তির বিষয়ে অবগত করে মন্তব্য জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বিবার্তাকে বলেন, যেসব রোগীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তাদেরকে বলুন, আমাদেরকে লিখিত অভিযোগ দিতে। তাহলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো। আর এক্ষেত্রে হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের কেউও অনিয়মের সাথে জড়িত থাকলে তাকেও ছাড় দেওয়া হবে না।


বিবার্তা/রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com