বিশ্বের প্রায় ২০ লাখ মানুষ প্রতি বছর ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। কোভিড-১৯ অতিমারিতে বেশির ভাগ মানুষই কাশি বা জ্বর হলেই আতঙ্কিত হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেন। কিন্তু অন্য সময় সর্দিকাশি বা জ্বর হলে কেউই খুব একটা আমল দেন না। শ্বাসযন্ত্রের কর্কট রোগের মূল উপসর্গ কাশি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগী যখন ডাক্তারের কাছে পৌঁছান তখন অসুখ প্রায় তৃতীয় স্টেজে পৌঁছে যায় এমনটাই দাবি চিকিৎসকদের। আর এই কারণেই ফুসফুসের ক্যান্সার আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ ১ বছরের মধ্যেই মারা যান।

আমাদের দেশের শহরাঞ্চলে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। শহরাঞ্চলের পুরুষরা সব থেকে বেশি ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। শহরাঞ্চলের দূষিত বায়ুর পাশাপাশি ধুমপান হলো এর সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ। ক্যান্সার আটকাতে সক্রিয় হলে একে আটকে দেয়া খুব কঠিন নয়। প্রত্যেক মানুষ যদি এই শপথ নেন, তা হলে শ্বাসযন্ত্রের কর্কট রোগকে নির্মূল করা সহজ হবে।

ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন অন্যান্য অসুখের মতো প্রাথমিক অবস্থায় রোগ ধরা গেলে চিকিৎসার সাহায্যে রোগের বিস্তার আটকে দেয়া যায়। তাই উপসর্গের শুরুতেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। তবে এই ক্ষেত্রে প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর— এই আপ্তবাক্য মেনে চলাই শ্রেয়। ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্য প্রত্যক্ষ ভাবে দায়ী তামাকের ধোঁয়া। সিগারেট বিড়ির নেশা থাকলে এই অসুখের ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। এমনকি সেকেন্ড হ্যান্ড বা প্যাসিভ স্মোকিং থেকেও ফুসফুসের ক্যান্সার হয়ে থাকে বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।

প্যাসিভ স্মোকিং এবং দূষিত পরিবেশ এবং লাগাতার ধোঁয়া ও অন্যান্য রাসায়ানিকের ধোঁয়ার প্রভাবে ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, নিকেল, ইউরেনিয়াম-সহ কিছু পেট্রোলিয়ামজাত রাসায়ানিক ফুসফুসের ক্যান্সার ডেকে আনতে পারে। জানা গেছে, যাদের শরীরে অঙ্কোজিন আছে অর্থাৎ এমন এক জিন আছে যেগুলি বিশেষ পরিস্থিতিতে ক্যান্সার যুক্ত টিউমার সেল তৈরি করতে সাহায্য করে অর্থাৎ যাদের বংশে ক্যান্সার রয়েছে, তারা যদি ধুমপায়ী হন তা হলে তাদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি খুব বেশি। অন্য দিকে, জীবনে একটিও সিগারেট টানেননি এমন মানুষের লাং ক্যান্সারের আক্রান্ত হওয়ার কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়েছে সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিং, ডিজেল সহ গাড়ির ধোঁয়া, কলকারখানার ধোঁয়াকে।

সাধারণত দুই ধরনের ফুসফুসের ক্যানসার দেখা যায়, স্মল সেল লাং ক্যানসার ও নন স্মল সেল লাং ক্যানসার। যারা অতিরিক্ত ধুমপান করেন তাদের মধ্যে স্মল সেল ক্যানসার বেশি দেখা যায়। অসুখটা কোন পর্যায়ে আছে, নির্ণয় করার পর ট্রিটমেন্ট প্রোটোকল ঠিক করা হয়। ক্যানসার যুক্ত টিউমার একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকলে প্রয়োজন হলে সার্জারির সাহায্য নেওয়া হয়। ছড়িয়ে পড়লে রেডিয়েশন ও কেমোথেরাপি করা হয়। ইদানীং টার্গেটেড থেরাপির সাহায্যে ফুসফুসের ক্যানসারের রোগীদের আয়ুষ্কাল বাড়ানোর পাশাপাশি কষ্ট অনেক কমানো গেছে বলে দাবি চিকিৎসকদের। অসুখ সন্দেহ হলে এক্সরে, স্পুটাম সাইটোলজি, বায়োপ্সি, সিটি স্ক্যান, পেট সিটি, বোন স্ক্যান, ব্রঙ্কোস্কোপি, এমআরআই-সহ নানান পরীক্ষা করতে হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে ফুসফুসের কর্কট রোগের প্রধান উপসর্গ কাশি। কোভিড আবহে কাশি হলে অবহেলা না করে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ফুসফুসের ক্যান্সার হলে কাশির সঙ্গে বুকের মধ্যে সাঁই সাঁই শব্দ, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, অল্প পরিশ্রমে হাঁপিয়ে পড়া, কাশির সঙ্গে রক্ত, এক নাগাড়ে মাথার যন্ত্রণা, গলা ধরে যাওয়া, কোনও কারণ কোনও কারণ ছাড়াই ওজন কমে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা যায়। ধুমপায়ীদের তো বটেই, যে কারোই এই ধরনের উপসর্গ শুরু হলে মনের জোরে সিগারেট টানা বন্ধ করতে হবে। দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে যথাযথ চিকিৎসা শুরু করতে হবে। ইদানীং টার্গেটেড থেরাপির সাহায্যে রোগীর কষ্ট লাঘব করে মৃত্যুহার কমানো গেছে। ধুমপান ছাড়ার শপথ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে বেরলেই মাস্ক পরা উচিত, এর ফলে বাতাসে ভাসমান দূষণের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। দূষণ প্রতিরোধেও সচেতন হতে হবে সবাইকে।

বিবার্তা/অনামিকা/জাই