শিরোনাম
করোনাভাইরাস: প্রতিরোধে যা বললেন চিকিৎসকরা
প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২০, ১৬:১৯
করোনাভাইরাস: প্রতিরোধে যা বললেন চিকিৎসকরা
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

এখন বিশ্বজুড়ে এক মহা আতঙ্কের নাম প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। ইতিমধ্যে বাংলাদেশেও তিনজনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত করেছে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। দেশে প্রথমবারের মতো এ তিনজনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার খবরে আঁতকে উঠেছেন দেশবাসী। মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।


বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস নিয়ে সারাদেশের সতর্কতামূলক বার্তার পাশাপাশি বেশ কিছু ভুল তথ্যও চলে যাচ্ছে মানুষের কাছে। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক না থাকায় মানুষের মাঝে বাড়তি আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেকেই করোনা আতঙ্কে মানসিকভাবে অসুস্থও হয়ে যাচ্ছেন।


তবে এই ইস্যুতে চিকিৎসকরা বলছেন, করোনাভাইরাসে আতঙ্কিত না হয়ে, হতে হবে সচেতন ও সাবধান। তাহলে কেবল এ ভাইরাসের প্রতিরোধ সম্ভব। এমতাবস্থায় করোনাভাইরাস থেকে বেঁচে থাকার উপায় এবং প্রতিরোধ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।


করোনাভাইরাস নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) মেডিকেলের প্রধান মেডিকেল অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. সারওয়ার জাহান মুক্তাফী বিবার্তাকে বলেন, বর্তমানে সারা বিশ্বে যে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে তা কোভিড-১৯ নামে পরিচিত। এই ভাইরাসের উপসর্গগুলো সাধারণত গলা ব্যথা, জ্বর ও শ্বাস কষ্ট হতে পারে। এ ভাইরাস মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে যেমন হাঁচি, কাশি, কফ, থুথু ইত্যাদির মাধ্যমে। এ ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসলে একজন থেকে আরেকজনে ছড়ায়।


করোনাভাইরাসের লক্ষণ নিয়ে তিনি বলেন,


১. এ ভাইরাস শরীরে ঢোকার পর সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিতে প্রায় ২-১৪ দিন লাগে।


২. বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রথম লক্ষণ জ্বর।


৩. শুকনো কাশি/গলা ব্যথা হতে পারে।


৪.শ্বাসকষ্ট/নিউমোনিয়া দেখা দিতে পারে।


৫. অন্যান্য অসুস্থতা যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, কিডনী সমস্যা, ক্যান্সার ইত্যাদি থাকলে অরগ্যান ফেইলিওর বা দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিকল হতে পারে।


করোনাভাইরাসের প্রতিকার নিয়ে ডা. সারওয়ার জাহান মুক্তাফী বলেন, যেহেতু এই ভাইরাসটি নতুন। তাই এর কোনো স্বীকৃত ভ্যাকসিন নেই, সুতরাং প্রতিরোধ নির্ভর করে সচেতনতার উপর। তাছাড়া এর চিকিৎসা হবে লক্ষণভিত্তিক।


এ ভাইরাসের প্রতিরোধ নিয়ে তিনি বলেন,


১. বার বার সাবান, পানি দিয়ে হাত ধোয়া ( অন্তত ২০ সেকেণ্ড) এবং ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চলা।


২. অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ না করা।


৩. আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা।


৪. হাঁচি, কাশির শিষ্টাচার মেনে চলা যেমন হাঁচি, কাশি দেয়ার সময় বাহু/টিস্যু/ কাপড় দিয়ে নাক, মুখ ঢেকে রাখা। হাতের কনুইয়ের ভিতরের অংশ ব্যবহার করা।


৫. অসুস্থ পশু/পাখির সংস্পর্শ পরিহার করা।


৬. খাবার ভালোভাবে ধুয়ে ও সিদ্ধ করে খাওয়া।


৭. অসুস্থ হলে ঘরে থাকুন, বাহিরে যাওয়া অতি দরকার হলে নাক-মুখ ঢাকার জন্য মাস্ক ব্যবহার করুন।


৮. জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত বিদেশ ভ্রমণ করা থেকে বিরত থাকুন ও এসময়ে ভ্রমণে সাবধানতা অবলম্বন করুন।


৯.যেখানে সেখানে কফ/থুথু না ফেলা।


১০. করমর্দন কোলাকুলি যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলা।


১১. করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখা।


১২. অফিসের ডেস্ক ও কম্পিউটারের কি-বোর্ড ব্যবহারের পূর্বে পরিষ্কার করে নেয়া।


১৩. ব্যাংক নোট বা টাকা পয়সা স্পর্শের পর হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।


ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. রফিকুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া অসুস্থ রোগী ও বয়স্করা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। তাই এ দুই শ্রেণির লোকদের সাবধানে থাকতে হবে। যেকোনো লক্ষণ দেখা দিলে সাথে সাথে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।


তিনি বলেন, আরেকটি বিষয় আমরা দেখতে পাই, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিভিন্নজন বিভিন্ন ফর্মুলার কথা বলে থাকে। এসব ফর্মুলা ব্যবহারের আগে আমাদের ভালো চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া দরকার। ভুল চিকিৎসা অনেক সময় হিতে বিপরীত হয়ে যায়।


ঢামেকের এ অধ্যাপক বলেন, করোনার যেহেতু প্রতিষেধক নেই, সেহেতু এ ভাইরাসের খবরে আতঙ্কিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি বলবো করোনার প্রতিষেধক সচেতনতা ও সাবধানতা। নিজে সচেতন থাকতে হবে, পরিবারকে সচেতন করতে হবে, সমাজেকে সচেতন করতে হবে। আর এভাবেই করোনাভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে হবে।


বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও একুশে পদকপ্রাপ্ত চিকিৎসক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত হবেন না। কারণ এই রোগে মৃত্যুহার খুব বেশি নয়। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, করোনায় মৃত্যুহার ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। সুতরাং এটি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু আমাদের কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। সেগুলো যথাযথভাবে মেনে চললেই এ ভাইরাসের সংক্রমণ এড়ানো সম্ভব হবে।


মেডিসিন বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, জ্বর দিয়ে করোনাভাইরাসের লক্ষণ শুরু হয়। জ্বরের সঙ্গে সর্দি, শুকনো কাশি, মাথাব্যথা, গলাব্যথা ও শরীর ব্যথা থাকতে পারে। এক সপ্তাহের মধ্যে শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। সাধারণ ফ্লুর মতোই হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।


আক্রান্ত কাউকে পাওয়া গেলে প্রথমেই তাকে কম করে দুই সপ্তাহ আলাদা করে রাখতে হবে, যাতে আক্রান্ত ব্যক্তি অন্যদের সংস্পর্শে না যেতে পারে। একই সঙ্গে যারা আক্রান্ত হননি, তাদের চলাফেরায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।


তিনি বলেন, করোনাভাইরাস মূলত শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায়। লক্ষণগুলো হয় অনেকটা নিউমোনিয়ার মতো। কারও ক্ষেত্রে ডায়রিয়াও দেখা দিতে পারে। তবে মানুষের দেহে ভাইরাসটি সংক্রমণের পর এক থেকে ১৪ দিনের মধ্যে লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো, তারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কিছু দিনের মধ্যে এমনিতেই সেরে ওঠেন। কিন্তু কিডনি, ডায়াবেটিস, হৃদযন্ত্র কিংবা ফুসফুসের পুরনো রোগীদের ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। একই সঙ্গে এটি নিউমোনিয়া, রেসপিরেটরি ফেইলিউর অথবা কিডনি অকার্যকারিতার দিকে মোড় নিতে পারে। এতে করে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুও ঘটতে পারে।


এদিকে দেশে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত তিনজনের মধ্যে দু’জনই নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইমতিয়াজ।


তিনি জানান, বাংলাদেশে যে তিনজন আক্রান্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে দু’জন নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা। তারা ঢাকায় চিকিৎসাধীন আছেন।


জানা গেছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিন ব্যক্তির মধ্যে দুজন ইতালি থেকে দেশে ফিরেছেন। এদের মধ্যে দুজন পুরুষ ও একজন নারী। তাদের বয়স ২০ থেকে ৩৫-এর মধ্যে বলে জানা গেছে।


নারায়ণগঞ্জের দুজনসহ তিন ব্যক্তি শনিবার (৮ মার্চ) আইইডিসিআরের হটলাইনে যোগাযোগ করেন। এরপর গত ২৪ ঘণ্টায় তাদের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় তারা করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) আক্রান্ত পজিটিভ রিপোর্ট আসে।


মঙ্গলবার (১০ মার্চ) আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, তবে আমাদের করণীয় আছে। তা হলো সতর্ক থাকা, যেখানে-সেখানে ময়লা না ফেলা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।


ওবায়দুল কাদের বলেন, করোনা মোকাবিলায় সরকার প্রস্তুত রয়েছে। এ ভাইরাস প্রতিরোধে সব ধরনের সতর্কতা ও প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে অনুযায়ী রাজধানী ঢাকার সব হাসপাতালে প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। জেলা-উপজেলার হাসপাতালগুলোও প্রস্তুত রয়েছে।


উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহরের একটি বন্যপ্রাণীর বাজার থেকে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস।এখন পর্যন্ত অন্তত ২৪টি দেশে শনাক্ত হয়েছে এই ভাইরাস। বাংলাদেশেও গত রবিবার এ ভাইরাসে তিনজন আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।


বিবার্তা/রাসেল/উজ্জ্বল/জাহিদ

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com