শিরোনাম
রঙিন জীবনের স্বপ্নে ধূসর জীবন!
প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০১৮, ১৭:১৬
রঙিন জীবনের স্বপ্নে ধূসর জীবন!
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

বাচ্চাটার বয়েস কতো হবে? সাত-আট হবে হয়ত। সে তার বাবা-মা'কে বার বার জিজ্ঞেস করছে,কেন শুধু আমাদের জিজ্ঞেস করল? কেন শুধু আমাদেরকেই থামতে হলো? কেন বার বার ওরা আমাদেরকেই জিজ্ঞেস করে?


তার বাবা-মা'কে দেখলাম এর কোন উত্তর দিতে পারছে না।


পুরো জাহাজে আমাদের মতো দেখতে কেবল ছিলাম আমি আমার মেট, সেই সঙ্গে একটা ভারতীয় পরিবার। বাবা-মা আর দুটো ছোট ছোট বাচ্চা। জাহাজেই পরিচয় হয়ছে পরিবারটির সঙ্গে।


দশ তলা এই জাহাজে কি নেই! শপিং মল, বার-পাব, রেস্টুরেন্ট, ডিসকো! বুঝার উপায়'ই নেই এটি একটি জাহাজ! মনে হবে ফাইভ স্টার কোন হোটেল!


পুরো জাহাজের যাত্রীদের সবাই সাদা চামড়া'র মানুষ। কেবল আমরা এই কয়জন'ই বোধকরি দেখতে একটু ভিন্ন ছিলাম!


স্টকহোম থেকে নিজদের শহরে ফিরেছি!


জাহাজ থেকে নেমে অনেক টুকু পথ হেঁটে বের হতে হয়। এই পথ টুকু'র মাঝখানে কারো কোন কিছু চেক করার কথা না। মানে পাসপোর্ট, ভিসা কিংবা আইডেন্টিটি কার্ড বা এই টাইপ কোন কিছু'ই চেক করার কথা না। কারণ, সুইডেনের স্টকহোম আর এস্তনিয়ার তালিন শহর দুটো সেঞ্জেন এলাকার অন্তর্ভুক্ত। ফ্রি মুভমেন্ট এলাকার এই সব দেশের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে সাধারণত এই ধরনের চেক-আপ করা হয় না।


তো, জাহাজ থেকে নেমে সবাই যে যার মতো করে বের হয়ে যাচ্ছে। মাঝ পথে অবশ্য দুই জন পুলিশ দাঁড়ানো আছে। তারা অবশ্য কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করছে না। স্রেফ দাঁড়িয়ে আছে। এই পুলিশ দুটো নাকি ওই ভারতীয় পরিবারটির কাছে তাদের পাসপোর্ট, আইডি কার্ড দেখতে চেয়েছে! আর এই জন্যই ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটি তার বাবা-মা'কে কেঁদে কেঁদে জিজ্ঞেস করছিল, ওরা কেন শুধু আমাদের কাছে'ই আইডি কার্ড চায়? কেন অন্যদের কাছে চায় না?


আমি ওই পথ দিয়ে'ই হেঁটে যাচ্ছি, দেখি বাচ্চা মেয়েটি জোরে জোরে কেঁদে তার বাবা-মা'কে জিজ্ঞেস করছে এই ব্যাপারটা।


আমি কাছে গিয়ে তার বাবা-মা'কে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে?


এরপর মেয়েটির বাবা পুরো ব্যাপারটা আমাকে পরিস্কার করে, উল্টো আমাকে জিজ্ঞেস করছে, আমার আসলে আমার এই বাচ্চা মেয়েটাকে কি উত্তর দেয়া উচিত? আমি তো রীতিমতো বিব্রত বোধ করছিলাম।


এই বাচ্চা মেয়েটার জন্ম হয়েছে এই দেশে, সে এই দেশের ভাষায় পরিস্কার কথা বলতে পারে। তারা বাবা-মা এই দেশে থাকছে প্রায় ১৭ বছরের বেশি সময় ধরে। মেয়েটি জন্ম সূত্রে'ই এই দেশের নাগরিক!


অথচ সে দেখছে স্রেফ দেখতে অন্য সব নাগরিকদের মতো না বলে পুলিশ তাদের বার বার আঁটকে দিচ্ছে, পরিচয় পত্র চাইছে! তার বাবাও এর সঠিক উত্তর দিতে পারছে না! এই বাবা কি করে তার ছোট্ট এই বাচ্চা মেয়েটিকে বলবে- আমরা যে দেখতে ভিন্ন! তাই আমাদের ওরা ভালো করে চেক সব সময় চেক করে!


তাহলে এই মেয়েটি বড় হতে হতে'ই বা কি শিখবে!


মেয়েটি কাঁদছে, আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ দুটোর কাছে গিয়ে বললাম, কিছু মনে না করলে, তোমরা কি আমার আইডি কার্ড'টা চেক করবে?


পুলিশ দুটো মহা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছে, কেন?


আমি পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চা মেয়েটাকে দেখিয়ে বললাম, দেখো মেয়েটা কাঁদছে। কারন তোমরা এই জাহাজ থেকে নামা আর কারো আইডি কার্ড চেক করোনি। স্রেফ এই পরিবারটার আইডি কার্ড চেক করেছ। মেয়েটি কেঁদে কেঁদে তার বাবা'কে জিজ্ঞেস করছে, কেন শুধু বার বার ওরা আমাদের কাছে'ই আইডি কার্ড চায়! মেয়েটা'র বাবা এর কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। তুমি যদি আমার কিংবা আশপাশের আরও কিছু মানুষের আইডি কার্ড চেক করো, তাহলে হয়ত মেয়েটার বাবা উত্তর দিতে পারবে,এই তো অন্যদেরও চেক করছে। এই মেয়েটি এই দেশে'ই জন্মেছে। সে দেখছে তার বয়েসি অন্য বন্ধু-বান্ধবরা জাহাজ থেকে নেমে'ই চলে যাচ্ছে আর ওরা যত বার যাওয়া-আসা করছে, তত'বার তোমরা ওদের থামিয়ে দিচ্ছ! জাহাজে উঠার সময় তোমরা এমন'কি আমার আইডি কার্ডও চেক করেছ; কারণ, আমিও দেখতে অন্যদের মতো না! আমার কথা না হয় মেনেই নিলাম। কারণ, আমি তো আর তোমাদের দেশের নাগরিক না। কিন্তু এই মেয়েটা কি দোষ করলো?


পুলিশ দুটোর চোখ তো কপালে উঠার জোগাড়! এরা এরপর আমার আইডি কার্ড চেক করেছে এবং অন্য আরও কয়েকজন সাদা চামড়া'র মানুষের আইডি কার্ডও চেক করেছে! আমার ধারণা আমার কথা শুনে পুলিশ দুটো তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে!


আমি মেয়েটাকে গিয়ে বললাম,মা, দেখলে তো ওরা আসলে অন্য আরও অনেকের আইডি কার্ডও চেক করেছে। কেবল তোমার বাবা-ম'কেই ওরা চেক করছে, ব্যাপারটা ঠিক এমন না! মেয়েটা এরপর কান্না থামিয়েছে। আমি তার বাবা-মা'র কাছ থেকে বিদায় দিয়ে ফেরত আসছি, পরিস্কার বুঝতে পারছি ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা'র চোখে হালকা জল! আমার নিজের চোখও খানিক ভিজে এসছে!


প্রায় ১৫ বছর হয় ইউরপে থাকছি। গবেষণা করছি শরণার্থী এবং অভিবাসীদের নিয়েই! এমন কতো'শত অভিজ্ঞতার গল্প আমি নিজ কানে শুনেছি গবেষণা করতে গিয়ে তার কোন হিসেব নেই!


প্রতিদিন কতো মানুষ আমাকে মেসেজ করে জানতে চায়, কিভাবে বিদেশে পড়তে যাওয়া যায়, দেশে ভালো লাগে না, বিদেশে সেটেল হতে চাই ইত্যাদি ইত্যাদি!
আমি এই ধরনের মেসেজ গুলো এড়িয়ে'ই চলি! কারণ, আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে- নিজ দেশের চাইতে ভালো জায়গা আর কিছুই হতে পারে না!


এখন হয়ত প্রশ্ন আসতে পারে- তাহলে আমি কেন বিদেশে পড়ে আছি!


আমি তো অতি অবশ্য'ই ফেরত যাবো। কোন দেশের নাগরিকত্ব নেবার সেই জন্য প্রয়োজনও বোধ করিনি কখনো। তবে যারা ফেরত যায় না, তাদের অনেকের'ই আসলে ফিরে যাবার আর কোন সেই অর্থে উপায় থাকে না! ঠিক অনেক'টা এই ভারতীয় পরিবারটির মতো। বাচ্চা গুলো জন্মেছে এখানে, তারা হয়ত ফিরে যেতে চায় না; কিংবা চাকরী-ব্যবসা, বাণিজ্য সব এখানে; তাই চাইলেও ফিরতে পারছে না!


দূর থেকে দেখে মনে হবে- এরা কতোই না আরামে আছে! দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে; দারুণ বাসায় থাকছে, দারুণ গাড়িতে চড়ছে। কিন্তু কাছে গেলেই বুঝা যায়- কতোটা ক্রাইসিসের মাঝ দিয়েই না তাদের যেতে হয়!


আমি নিজেও এক সময় মনে করতাম- আহা, বিদেশে লোকজন কতোই না ভালো আছে! নিজের গবেষণা এবং নিজের একান্ত সব অভিজ্ঞতা আমাকে ভিন্ন কিছু জানান দিয়েছে!
বিদেশে থাকা মানুষ গুলো দিন শেষে ফেসবুকে সুন্দর একটা ছবি আপলোড দিয়ে হয়ত দেখাতে চায়- কতোই না ভালো আছি! আর আপনারাও ভাবেন-বাহ! এরা কতোই না ভালো আছে!


আসল গল্পটা আসলে অনেক বেশিই ভিন্ন!


মঈন আলী'র উদাহরণটাই দেয়া যাক। সে ইংল্যান্ডের হয়ে ক্রিকেট খেলে। ইংল্যান্ডের নাগরিক তো অবশ্যই। অথচ স্রেফ দেখতে ভিন্ন, মুসলিম নাম এবং মুখে দাঁড়ি থাকার জন্য তার নিজ দেশের এয়ারপোর্টে তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেক করা হয়! অথচ সে একজন জাতীয় দলের খেলোয়াড়! দেশের জন্য সে খেলছে! সঙ্গের অন্য খেলোয়াড়দের অবশ্য সেই ঝামেলার মাঝ দিয়ে যেতে হয় না!


এই রকম হাজারটা উদাহরণ দেয়া যাবে!
আমি দেশে এমন হাজারটা পরিবারের কথা জানি- যারা তাদের বাচ্চার ভবিষ্যতের জন্য দেশ ছেড়ে বিদেশ পাড়ি জমাতে চান!


আমি ভাবছিলাম-ওই বাচ্চাটার কথা! সে বড়ই হবে এক ধরনের পরিচয় সঙ্কটকে সঙ্গী করে! না হবে সে এই সমাজের; না হবে সে ওই সমাজের !
এ এক অনন্ত সঙ্কট!


দেশে বসে যারা ইউরোপ-আমেরিকার রঙিন জীবনের ছক আঁকেন; তাদের বলতেই হচ্ছে- রংতুলি'তে সেই রঙিন ছবি আঁকার জন্য এই মানুষ গুলোকে বিদেশে এসে একটা সময় নিজেকেই হারিয়ে খুঁজতে হয়!


যেই ছবিটা শেষ পর্যন্ত তারা নিজেদের রংতুলিতে আঁকে; সেটা কি আদৌ তাদের নিজের ছবি কিনা, সেই উত্তরটাও তারা আর খুঁজে পায় না!


আমিনুল ইসলামের ফেসবুক থেকে


বিবার্তা/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com