সেবার রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত এক সেমিনারে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা তোমাদের দেশটা আসলে ঠিক কিভাবে টিকে আছে?
এই প্রশ্ন করে তিনি আমাকে আর উত্তর দেয়ার সুযোগ দে্ননি। নিজেই বলেছেন, এতো এতো মানুষ এতটুকু একটা দেশে! চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ; এরপরও এক অর্থে দেশটা ঠিকঠাকমতোই চলে যাচ্ছে। তোমাদের দেশের দিকে তাকালে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় উপরওয়ালা বলে কেউ একজন আছেন! তিনিই হয়ত চালিয়ে নিচ্ছেন!
আমি স্রেফ হেসেছিলাম। তিনি অবশ্য সেমিনারে কোনো বক্তব্য হিসেবে একথা বলেননি। সেমিনার শেষে আমরা দু'জনে কথা বলছিলাম। কথার কথা হিসেবেই বলেছিলেন।
তখন সুইডেনে থাকি। পাশের অ্যাপার্টমেন্টে ভদ্রলোক থাকতেন, একদিন দেখি বলা নেই, কওয়া নেই; তিনি চলে যাচ্ছেন অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, হঠাৎ করেই মনে হয় চলে যাচ্ছ! কি ব্যাপার?
ভদ্রলোক বললেন, আমি আসলে বেশ মানসিক সমস্যার মাঝ দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের দুই ফ্ল্যাট পরে যে ভদ্রলোক থাকেন, তুমি কি দেখেছ ক'দিন পরপরই তিনি দামী দামী গাড়ি বদলান আর আমি সেই আগের মডেলের গাড়িটাই ব্যবহার করছি! আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় ওর মতো গাড়ির মডেল বদলাতে। কিন্তু পারছি না। এটা আমাকে অনেক মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছে। ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি। ডাক্তার বলেছেন, যদি সম্ভব হয় এ এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে। তাই চলে যাচ্ছি!
মাসকয়েক আগে এক ছেলে আমাকে একটা মেসেজ করেছিল। আমি ছেলেটাকে চিনি না। সে হয়ত আমার লেখা ফলো করে। সে লিখেছে, স্যার, অামার বাবা তার প্রথম স্ত্রীর কথা গোপন করে অামার মাকে বিয়ে করে। মা তার বাবার বাড়িতেই থাকতো। যখন অামার জন্মের এক বছর পর বিষয়টা জানাজানি হয় তখন তাদের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। মা অামাকে নানীর কাছে রেখে ঢাকা চলে অাসে কাজের সন্ধানে। এখানে মা একজন রিক্সাচালককে বিয়ে করে ফেলে। বাবার শুধু মাথা গোঁজার মতো একটা বাড়ি অাছে। সে তার সংসার নিয়ে ব্যস্ত,কখনো অামার খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন অনুভব করেনি। অার মা তার সংসার নিয়ে ব্যস্ত, তবে মাঝে মাঝে অামাকে দেখতে অাসতেন।
অামার বয়স যখন নয়-দশ বছর তখন অামার নানী মারা যান, এর বছরখানেক পরে অামার নানাও মারা যান। অামার মামার শুধু থাকার বাড়িটা ছাড়া অার কিছু নেই, তাই তিনি অামার দায়িত্ব নিতে না পারায় অামাকে এক বাড়িতে রাখালের কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়। এক পর্যায়ে অামি সেখান থেকে পালিয়ে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে থাকি। যার কাজ করি তার বাড়িতেই থাকি। পড়ালেখার ও থাকাচ-খাওয়ার সুযোগ দেয়ার শর্তে এক বাড়িতে তাদের যাবতীয় কাজ করে দিতে রাজি হই। তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়ার অভিজ্ঞতা ছিলো, হাতে পায়ে লম্বা হওয়ায় সরাসরি ভর্তি হই ক্লাস সিক্সে। কাপড় কাচা, রান্নাবাড়ার যাবতীয় কাজ, থালাবাসন মাজা ইত্যাদি করতাম শুধু লেখাপড়ার স্বার্থে।
এর পর একটা ওষুধের দোকানে কাজ নিই, সিক্স থেকে এইটে ভর্তি হই, এইটে ফাইনাল না দিয়ে অাবার ওই বছরই উন্মুক্তে নাইনে ভর্তি হই। কারণ, দোকানে বারো-তেরো ঘন্টা কাজ করে ক্লাস করার কোনো সুযোগ ছিলো না। অন্য সকল কাজের চেয়ে দোকানের কাজটা অামার কাছে অনেক সম্মানের ছিলো। এরপর কলেজ ভর্তি হলে স্বাধীনতা পাই। মেসে থাকার সুযোগ পাই, দোকান থেকে মেস খরচ চলে অার অামি কাজের ফাঁকে ফাঁকে দু'একটা ক্লাস করার সুযোগ পাই। তার পর থেকে অামার চোখ ফুটতে থাকে। দোকান পরিবর্তন করি, থাকা খাওয়া ও পড়ালেখার খরচ ভালোই চলছিলো। অনার্সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাই, চান্সও পেয়ে যাই। দোকানে বারো-তেরো ঘণ্টা কাজ করে করে অনার্সটা শেষ করলাম। শুধু একটা ডিগ্রীই পাবো, কিন্তু যতোটা জানার কথা সেটা অার জানা হলো না।
কিছুদিন হলো ঢাকায় অাসছি, এখানেই কোথাও মাস্টার্স করবো। অার দোকানে কাজ করতে চাই না। পড়ার একদম সময় পাওয়া যায় না। আমার একটু সময় দরকার যাতে ভালো করে পড়তে পারি, জানতে পারি।
এবার আসি পাকিস্তানের এক টেলিভিশনের টক শো-র আলোচনায়। পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নাকি ঘোষণা করেছেন, পাকিস্তানকে সুইডেনের মতো করে গড়ে তুলবেন!
তো, তার এই ঘোষণার পর পাকিস্তানের এক টেলিভিশনে কয়েকজন আলোচক আলোচনা করছিলেন। এর মাঝে একজন অর্থনীতিবিদও ছিলেন। তিনি কথা প্রসঙ্গে বলেছেন, সুইডেন তো দূরে থাক, ইমরান খান যদি পাকিস্তানকে বাংলাদেশের মতো সমৃদ্ধ একটা অর্থনীতির দেশে পরিণত করতে পারে, তাহলেও আমাদের খুশি হওয়া উচিত।
এরপর তিনি বলেছেন ইমরান খান শুধু পাঁচ বছর না দশ বছরের মাঝেও যদি বাংলাদেশের কাছাকাছি আমাদের নিয়ে যেতে পারে, তাহলেও আমাদের খুশি হওয়া উচিত। কারণ, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যে অবস্থায় আছে তাতে ওদের ধারেকাছে আমরা আদৌ যেতে পারব কিনা সন্দেহ।
এই কথাগুলো পাকিস্তানের একজন অর্থনীতিবিদ পাকিস্তানের টেলিভিশনে বলেছেন। এটা সেই পাকিস্তান যারা আমাদের ছোট-খাটো কালো জাতি বলে অপমান করত। এটা সেই পাকিস্তান, যারা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে, আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মেরেছে; পুরো দেশটাকে বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিল একটা ধ্বংসস্তূপে।
সেই ধ্বংসস্তূপ থেকেও আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি। শুধু উঠেই দাঁড়াইনি; পাকিস্তানীদের চাইতে এতোটা এগিয়ে গিয়েছি, তারা এখন স্বপ্ন দেখছে আগামী ১০ বছরে যদি আমাদের ধারেকাছে আসা যায়!
এর কারণ জানার জন্য খুব বেশি দূরে যেতে হবে না। ওপরে যে ছেলের গল্পটা লিখলাম সেটা জানলেই চলবে। হাজারো প্রতিবন্ধকতা থাকার পরেও সে তার লেখাপড়া চালিয়ে নিচ্ছে এবং থেমে যায়নি।
আমরা বাংলাদেশিরা খুব সহজেই সুখী হতে পারি। আমাদের চাওয়া-পাওয়া কখনোই খুব বেশি ছিল না। যার কারনে এতোটুকু একটা ছোট দেশে কোটি কোটি মানুষ হবার পরও আমরা এগিয়ে গিয়েছি।
ছোট-খাটো একটা চাকরী, দিন শেষে বাসায় ফিরে বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী মিলে রাতের খাবার খাওয়া, মাঝে মাঝে ক্রিকেট খেলায় বাংলাদেশ জিতলে আনন্দ মিছিল করা; এইসবই আমাদের চাওয়া। আমাদের সুইডেনের ওই ভদ্রলোকের মতো মাসে মাসে গাড়ি পরিবর্তন করার ইচ্ছে জাগে না!
আমরা কেবল খেয়ে-পরে আত্মীয়স্বজন নিয়ে বেঁচে থাকতে পারলেই খুশি। মাঝে মাঝে আমাদের রাজনীতিবিদরা আমাদের সেই সুযোগটুকুও দেন না। আমাদের গুম করে ফেলেন, আমাদের অধিকার কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করেন।
আমরা এরপরও থেমে থাকি না। এগুতে থাকি। ঠিক যেমনটা ওই ছেলে এগুচ্ছে।
তার বাবা-মা এবং পরিবারের ইতিহাস আমাকে লিখে পাঠানোর পর আমি তাকে লিখেছিলাম, তোমার সঙ্গে আমি পরে যোগাযোগ করবো।
এরপর গত রোজার ঈদে তাকে আমি লিখেছি, তুমি কি আমাকে বলবে, কিভাবে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি?
আমি তাকে ঈদের দিন এই কথা লিখেছি। কারণ প্রতি ঈদেই আমি সাধারণত সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখি- কাউকে না কাউকে আমার সাধ্যমতো সাহায্য করার চেষ্টা করবো।
ওই ছেলে উত্তরে লিখেছে - স্যার, টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে হবে না আমাকে। আমি মাস্টার্স করতে চাই ঢাকায়। আমাকে যদি পারেন একটু গাইডলাইন যদি দিতেন। তবে আমি আপনাকে মেসেজ করেছি মূলত আমার একটা ইচ্ছের কথা জানাতে- আমার খুব ইচ্ছে আপনার সঙ্গে বসে খানিক সময় কথা বলার এবং চা খাওয়ার।
আমি ছেলেটার টেক্সট পেয়ে খুব অবাক হলাম। যে ছেলেটার বাবা-মা থেকেও নেই, মানুষের বাসা-বাড়িতে থালা-বাসন মাজা, কাপড় ধোয়ার কাজ ইত্যাদি করে, একদম পড়ার কোন সময় না পেয়ে যে ছেলেটা অনার্স শেষ করছে; যাকে আমি সাহায্য করতে চাইলাম- সে কিনা উত্তরে লিখেছে - আপনি আমাকে উত্তর দিয়েছেন, এতেই আমি অনেক খুশি হয়েছি। আপনার সঙ্গে বসে একটু কথা বলতে পারলেই আমি খুশি হবো!
হঠাৎ করে তাই রাশিয়ান ওই রাষ্ট্রদূতের কথা মনে হলো। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, কোটি কোটি মানুষ, এরপরও আমরা এগুচ্ছি কিভাবে।
এগুচ্ছি কারণ আমরা অল্পতেই খুশি। কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে এখন আবার যুক্ত হয়েছে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা! পুরো ইউরোপ মহাদেশে সব মিলিয়ে মাত্র ২০ লক্ষ শরণার্থীকে দেশগুলো কিভাবে ভাগাভাগি করে নেবে, এই নিয়ে চলছে নানান রাজনীতি। এমনকি এর জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নও ভেঙে যাবার কথা বলছে অনেকে! কারণ কেউ এই শরণার্থীদের নিতে চায় না।
পুরো ই-ইউ'তে ৩০টির মতো দেশ। এরা সবাই মিলে ২০ লাখ শরণার্থী ভাগাভাগি করতে পারছে না, আর বাংলাদেশ একাই প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে বসে আছে!
জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক থেকে বাংলাদেশ বোধকরি একদম প্রথমেই এই গ্রহে। দেশ হিসেবেও আমরা দরিদ্র। খুব একটা স্বচ্ছল দেশ আমরা এখনও হয়ে উঠতে পারিনি।
কিন্তু আমরা জানি কিভাবে খাদের কিনারা থেকে উঠে দাঁড়াতে হয়। কোনোকিছু না থেকেও কিভাবে সুখী হতে হয়।
আমাদের দেশ নিয়ে আমরা অতি অবশ্যই সমালোচনা করবো। আমাদের অনেক সমস্যা আছে। সমালোচনা আমরা অবশ্য'ই করবো। সমালোচনার মাধ্যমেই আমরা সামনে আরও এগুবো।
কিন্তু সেই সঙ্গে এটা ভুলে গেলেও চলবে না, আমাদের গর্বের জায়গা আছে। সেই জায়গাটা আমাদের পুরো পৃথিবীকে দেখিয়ে দিতে হবে। যেমন এই ছেলেটি। সে সাহায্য চায় না, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। সে চায় তার ছোটখাটো ইচ্ছেগুলো পূরণ হোক।
তুমি যখন তোমার ইচ্ছেটার কথা জানিয়েছ, আমি তোমাকে কোনো উত্তর দেইনি আজ পর্যন্ত। ভেবেছিলাম এ নিয়ে কিছু লিখবো।
পরের বার যখন দেশে যাবো, আমি প্রথমেই তোমার সঙ্গে দেখা করবো। এতো ছোটখাটো ইচ্ছে অপূর্ণ রাখা একদম ঠিক না। আমি জানি, তোমরাই এই দেশের ভবিষ্যৎ।
আমিনুল ইসলামের ফেসবুক থেকে
বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]