সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফরাশি লেখক, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অ্যালবেয়ার ক্যামু ছিলেন একজন পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড়। খেলতেন গোলকিপার পজিশনে। এই পজিশনকে তিনি সংজ্ঞায়িত করেছেন ‘নিঃসঙ্গতা’ ও ‘সংহতি’ এই দুই শব্দ দিয়ে। এক-নম্বর জার্সি পরে গোলপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে ক্যামু শিখেছিলেন তাঁর জীবনদর্শন - “আমি শিখেছিলাম, যখন তুমি আশা করছ এবারে বল আসছে, সেসময় কখনোই তা আসে না!”
আলিমুদ্দিন ভাই - আমার দেখা সেরা গোলকিপার। তাঁকে মাঠের বাইরে আমাদের বাড়িতেই বেশি দেখেছি আমি। আমাদের কাছারি ঘরে। এই কক্ষ ছিল ঝাড়কাঁটা স্কুলের খেলোয়াড়দের নৈমিত্তিক মিলনমেলা। সর্বক্ষণ ৮/১০ জন ফুটবল খেলোয়াড় এখানে বসবাস করত। আমার চাচা চান মাস্টার ছিলেন এদের পৃষ্ঠপোষক। প্রবল নেতৃত্বগুণ দিয়ে তিলতিল করে তিনি গড়ে তুলছিলেন স্কুলের দুর্দান্ত ফুটবল দল। থানা, মহকুমা, এমনকি জেলার সীমানা পেরিয়ে এই দল ঢাকা বিভাগ আন্তঃস্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতায় রানার আপ স্থান অর্জন করেছিল।
আলিমুদ্দিন ভাই ছিলেন আমার চাচার বন্ধু। বয়সে তার চেয়ে কয়েক বছরের ছোট। কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন, তা জানি না। সত্তুরের দশকে ফুটবল আমাদের এলাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। এই সময়ে তিনি ঝাড়কাঁটা স্কুল প্রাক্তন ছাত্র সমিতির (Jharkata Old Boys’ Association বা JOBA) দুর্ভেদ্য গোল কিপার। তার ফুলহাতা জার্সির সামনে-পেছনে বুক আর পিঠের ওপরে লাল রঙ দিয়ে আঁকা ফুল - রক্তজবা। টকটকে লাল।
ঝাড়কাটা স্কুল দলের মতো এই সমিতিও তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার শ্রেষ্ঠ ফুটবল দল। বিপরীত পক্ষের খেলোয়াড় দল যত শক্তিশালীই হোক না কেন, আলিমুদ্দিন ভাইকে অতিক্রম করে গোলবারের ভেতরে বল ঢোকানোর সামর্থ্য তাদের নেই। শীর্ণ দেহের আলিমুদ্দিন ভাই যখন প্রবল ক্ষিপ্রতা নিয়ে গোলপোস্টের সামনে চলাফেরা করেন, বিপরীত পক্ষের খেলোয়াড়রা বুঝতেই পারে না কতটা দ্রুততার সাথে, কত বেগে, কোন কোণে বল ছুঁড়লে আলিমুদ্দিন ভাইকে পরাজিত করা সম্ভব। আলিমুদ্দিন ভাই যখন টাইব্রেকারে ৫ টার মধ্যে ৩/৪ টা বলই বিদ্যুতের বেগে ফিরিয়ে দেন, এলাকার হাজার হাজার দর্শকের হৃদয় স্বর্গীয় আনন্দে দুলতে থাকে। ‘জবা’র খেলা মানেই আলিমুদ্দিন ভাইয়ের একচ্ছত্র আধিপত্য।
শুরুতেই বলেছি, প্রায় সকল সময়েই আলিমুদ্দিন ভাই আমাদের বাড়িতেই থাকেন। খাওয়াদাওয়া করেন। বিকেলে স্কুলের ছেলেদের সাথে মাঠে নিজে অনুশীলন করেন। নবীন প্লেয়ারদের অনুশীলন করান। তিনি একজন স্বতঃপ্রণোদিত কোচ। তার বাড়ি স্কুলের পশ্চিম পাশের নিশ্চিন্তপুর গ্রামে। বাড়িতে তার পরিবার আছে। আমার বয়সী তার একটা ছেলেও আছে। নাম বাদল। আর আছে একটা সাইকেল মেরামতের দোকান। বাড়ির উঠোনে। মাঝেমধ্যে সকালের দিকে তিনি সেখানে সাইকেল মেরামত করেন। ইটের ঝামা দিয়ে সাইকেলের লিকযুক্ত গোলাপি রঙের টিউবের ওপরে তিনি যখন সুগন্ধীযুক্ত লিকুইড সলিউশন মাখেন, তখন পুরো উঠোন গন্ধে মৌ মৌ করতে থাকে। তবে এই কাজ দিয়ে তার সংসার চলে কিনা তা আমার জানা নেই।
আলিমুদ্দিন ভাইয়ের সাথে ফুটবল খেলতে খেলতেই আমিও একসময়ে ভালো খেলোয়াড় হয়ে যাই। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়েই আমি স্কুলের ‘বি’ দলের ব্যাক। ক্লাস এইটে পড়ার সময়ে কলেজ ফুটবল টিমের জন্য ঢাকার আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব হতে কোচ আনা হয়েছে। তাসনিম ভাই (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তাসনিম) আমাদের নজরুল হাউজের হাউজ ক্যাপ্টেন। ক্যাডেট কলেজ তার মতন বহুমুখী প্রতিভা আর কখনই পায়নি। ফুটবল, ভলিবল, বাস্কেট বল, ক্রিকেট, কবিতা আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতা, গান বাজনা, ছবি আঁকা সবকিছুতেই তিনি অনন্য। আমাকে কলেজ টিমের অনুশীলনের জন্যে ব্যাক পজিশনের খেলোয়াড় হিশেবে নির্বাচন করা হয়েছে। একদিন অনুশীলনের ফাঁকে তাসনিম ভাই আমাকে বললেন, “ তোমার বলের স্পিড দেখে আমি মুগ্ধ। কার কাছ থেকে এমন শ্যুট করা শিখেছ?” সাথে সাথেই মনে পড়ে গেল আলিমুদ্দিন ভাইয়ের কথা।
মনে পড়লো, স্কুলে পড়ার সময়ে প্রতিদিন বিকেলে খেলা শেষ হয়ে যাবার পর গোধূলির আলোআঁধারির ভেতরে আলিমুদ্দিন ভাই আমাকে বলে কিক করা শেখাতেন। নিজে গোলকিপার পজিশনে থেকে। মাঠের প্রায়ান্ধকারের ভেতরে তাকে মনে হয় যেন অশরীরী আত্মা। আমি গোলপোস্টের যত্রতত্র বল ছুঁড়ে দিচ্ছি। অন্ধকারের ভেতরেও সেগুলো আঁটকে যাচ্ছে পেছনের নেট স্পর্শ করার মুহূর্তপূর্বে। আমিও প্রাণপণে বলে একটার পর একটা কিক করে যাচ্ছি। অবিরত।
আমি তখন সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন। থাকি আর্মি হেডকোয়ার্টার অফিসার্স মেসে। আলিমুদ্দিন ভাই মাঝে মধ্যেই গ্রাম থেকে আমার কাছে আসেন। সন্ধ্যার পর আমরা দু'জনে মিলে নিবিড় আলাপে মেতে উঠি। তার ছেলের চাকুরি হয়েছে পুলিশে। তাকে খুব-একটা দেখাশুনা করে না। আমাদের বাড়িতেও খেলোয়াড়দের মিলনমেলা ভেঙে গেছে। আমার মেজ চাচা চান মাষ্টার স্কুলের চাকুরি ছেড়ে দিয়ে গ্রাম্য সালিশের মধ্যমনি হয়েছেন। আমাদের স্কুলের সহকারী হেড মাষ্টার একজন দুর্দান্ত স্ট্রাইকার ছিলেন। স্কুল ছেড়ে এসে তিনি ঢাকার বিখ্যাত এক স্কুলের হেড মাস্টার হয়েছেন। আলিমুদ্দিন ভাই প্রায়ই তার বাসায় যান।
একদিন আমার সেই স্যার আমাকে বললেন, “আলিমুদ্দিন কি তোমার কাছে যায় ?” আমি হাঁ-সূচক জবাব দিতেই তিনি বললেন, “তোমার কাছে সে টাকা-পয়সা চাইলে দিও না। ওর স্বভাব নষ্ট হয়ে গেছে। তার এই অযথা ঘুরে বেড়ানোর স্বভাব আমি পছন্দ করি না। কিন্তু বন্ধুমানুষ। কিছু বলতেও পারি না”। আমি ভীষণ অবাক! ছোট বেলায় যখন আলিমুদ্দিন ভাই আমাদের বাড়িতে সারাদিন থাকতেন, খাইতেন-দাইতেন তখন তো কেউ তার স্বভাব নষ্ট হয়েছে বলেনি!
আরও কয়েক বছর পর। ছুটিতে বাড়িতে গিয়েছি। বিকেলে স্কুলের মাঠে যেতেই ছেলেদের কাছে শুনলাম আলিমুদ্দিন ভাই মারা গেছেন। একমাস পূর্বে। ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে। তার শেষ সময়ে তেমন কেউই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসেনি। ঠিক যেন গোলপোস্টের নিচে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা গোলকিপারের অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি, “যখন তুমি আশা করছ এবারে বল আসছে, সেসময় কখনোই তা আসে না!”
ছবি ঘর আসাদের ফেসবুক থেকে
বিবার্তা/হুমায়ুন/কামরুল
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]