বাবা-মা হারানো ছেলেটা হয়তো রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ঢাকাতে এসছিল।
বেঁচে থাকার জন্য, পড়াশুনার খরচ চালানোর জন্য সে কোনো রাজনৈতিক দলের ছায়ায় চাঁদাবাজি করত না। টিউশনি করেই নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার চেষ্টা করছিল।
ঢাকার রাজপথে দুই বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় তার ডান হাতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল!
অসুস্থ ছেলেটাকে একটা বেসরকারি হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। সেখানকার চিকিৎসা খরচ এতোই বেশি, তার আত্মীয়-স্বজন তাকে এরপর ঢাকা মেডিকেলে ট্রান্সফার করেছে।
জানি না ছেলেটার ভাগ্যে কি ঘটবে।
তবে আমি মোটামুটি নিশ্চিত, যেই দুই বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে এই ঘটনা ঘটেছে, সেই বাস মালিকদের কিছুই হবে না! কারণ, ঢাকা শহরের গনপরিবহণ খুব অল্প কিছু মানুষের হাতে জিম্মি হয়ে আছে। তারা এই পুরো সেক্টর দখল করে রেখেছে। এদের ক্ষমতা এতোই বেশি, আপনি যদি খুব ভালো সেবা দিয়ে একটা বাস সার্ভিস চালু করেন, এরা সেই সেবা বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করবে।
তবে আপনার চালু করা নতুন সার্ভিস যদি এরা বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করে, তাহলে সেটা হবে আপনার জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার। কারণ, এরা অন্তত আপনার জীবনটা তো নিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেনি! তবে যদি শেষমেশ বন্ধ না করেন; তাহলে সেই জীবনটাও হয়ত আর থাকবে না!
আমি জানি, ছেলেটার বিচ্ছিন্ন হাত সমেত ছবিটা যেহেতু দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্র-পত্রিকায় এসছে, হয়ত অনেকেই এখন তার চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে চাইবে কিংবা এককালীন কিছু আর্থিক সাহায্যও হয়ত সে পাবে।
আমি একজন ভদ্রমহিলাকে জানি, যার এমন একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল। যিনি আমার লেখা নিয়মিত পড়েন। আমি তাকে সেই অর্থে চিনি না, তিনি স্রেফ আমার লেখা ফলো করেন।
এক্সিডেন্টের পর তিনি যেই কয়দিন হাসপাতালে ছিলেন, আমার লেখা পড়ে তিনি নাকি মনোবল পেতেন। সেই ভদ্রমহিলা কিছুদিন আগে আমাকে লিখেছেন, “আমার আশপাশের মানুষজন এখন আমাকে দেখে করুনা করে। হাত-পা হারানো শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষের আসলে এই সমাজে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না।”
ভদ্রমহিলা আমাকে আরো লিখেছেন, “তার আশপাশের অনেক মানুষ নাকি তাকে বলেছে, এর চাইতে মরে যাওয়াও ভালো ছিল।”
আমাদের সমাজটাই আসলে এমন।
যেই ছেলেটার ডান হাতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, যেই ছেলেটা হাসপাতালে তার বাম হাত দিয়ে ডান হাত'টা খুঁজে ফিরছে; সে এই হাত দিয়েই ভবিষ্যৎয়ের রঙিন স্বপ্ন আঁকছিল!
রাজপথে একটা হাত হারিয়ে ফেলার পর পত্রিকাগুলো তাকে নিয়ে "মেধাবী ছাত্রের হাত হারানো" শিরোনাম করেনি! বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাজপথে নেমে এসে আন্দোলনও করেনি! কারণ, সে কোনো বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল না; তার কোনো রাজনৈতিক পরিচয়ও নেই! সে ছিল টিউশনি করা অতি সাধারণ ছাত্র!
তার জন্য আমাদের মিডিয়া দুই একদিন দুই কলম লিখবে, আমার মতো মানুষজন আবেগে ভেসে গিয়ে এমন কিছু লেখাও লিখে ফেলবে।
এরপর শুরু হবে কঠিন বাস্তবতা! যেই বাস্তবতা তাকে প্রতি মুহূর্তে জানান দিবে - শুধু ডান হাতটা না; ওই দুই বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তার জীবনের রঙিন স্বপ্নগুলো!
এই সমাজের মানুষগুলো তাকে শারীরিক প্রতিবন্ধী হিসেবে দেখবে; কেউ হয়ত বলে বসবে - এর চাইতে মরে গেলেও ভালো হতো!
এটাই আমদের সমাজ। এই সমাজ স্বপ্ন দেখতে শেখায় না; স্বপ্ন গুলো ভাঙতে শেখায়!
কারো স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে, সেই ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্নগুলোকে জোড়া লাগাতে নয়, এই সমাজ সেই ভাঙ্গা স্বপ্নগুলোকে দুঃস্বপ্ন পরিণত করতে শেখায়!
আমিনুল ইসলামের ফেসবুক থেকে
বিবার্তা/মৌসুমী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]