শিরোনাম
মেধাহত্যার নীরব যজ্ঞ
প্রকাশ : ০১ এপ্রিল ২০১৮, ১৭:৪৪
মেধাহত্যার নীরব যজ্ঞ
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক ছেলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের'ই এক ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে শনিবার রাতে। ছেলেটি একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগে সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স করছিল।


পত্রিকা পড়ে জানতে পারলাম, তার পরিবারের সদস্যরা বলেছে, সরকারি চাকরী না পাওয়াতে তার মাঝে এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়েছিল। এই ছেলের বয়স ৩০ হচ্ছিলো এই বছরেই। তার ফ্যামিলির সদস্যদের সে নাকি বলেছে, এতো ভালো পরীক্ষা দেই, এরপরও কোথাও চাকরী হচ্ছে না। এদিকে সরকারি চাকরীর বয়েসটাও শেষ হয়ে যাচ্ছে!


তবে এই ছেলে কিন্তু একটা বেসরকারি চাকরী করছিল! এই নিয়েও নাকি তার মাঝে হতাশা কাজ করত। সে নাকি তার পরিবারের সদস্যদের বলেছিল, আমি বেসরকারি চাকরী চাইনি, চেয়েছি সরকারি চাকরী।


আপনাদের জানিয়ে রাখি, এই ছেলে কিন্তু কোনো দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসেনি অর্থাৎ ব্যাপারটা এমন না যে চাকরী না পাওয়া কিংবা সরকারি চাকরী না পাওয়ার জন্য পেট চলছে না কিংবা জীবন আটকে আছে।


ছেলেটার বাবার ঢাকা শহরে বাড়ি আছে। ঢাকা শহরে বাড়ি থাকা মানে আর যা-ই হোক, ছেলেটা দরিদ্র নয়। তাহলে সরকারি চাকরী না পেয়ে তার মাঝে হতাশা চলে এল কেন? সেই হতাশা থেকে সে আত্মহত্যাই বা করল কেন?


এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই কিছুদিন আগে আরেকটা ছেলে আত্মহত্যা করেছিল। ওই ছেলেটিও বিজনেস ফ্যাকাল্টির ছাত্র ছিল। গ্রাম থেকে উঠে আসা হ্যাংলা-পাতলা ছেলেটার গায়ের রঙ খুব কালো ছিল। তার হলের সহপাঠীরা নাকি নিয়মিত তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করত। কারণ, তার গায়ের রঙ কালো আর দেখতে-শুনতে ভালো না! এমনকি তার ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকরাও নাকি এই শারীরিক অবয়বের জন্য তাকে ''কথা'' শুনিয়েছে। সেই সঙ্গে ডিপার্টমেন্টের পড়াশুনার চাপও যুক্ত হয়েছিল। ছেলেটা এমনকি ডিপার্টমেন্ট পরিবর্তনও করতে চেয়েছিল। সেকথা শিক্ষকদের বলাতে শিক্ষকরা নাকি তাকে উল্টো দু'কথা শুনিয়ে দেন!


এত সব চাপ সহ্য না করতে পেরে ছেলেটা শেষমেশ আত্মহত্যাই করে ফেলে!


যেই ছেলেটা সরকারি চাকরী না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে; গিয়ে দেখবেন সে যখন তার শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে যেত; শিক্ষকরা হয়ত তাকে বলে বসেছেন, সরকারি চাকরী পাচ্ছ না?


আমার নিজের বেলাতেই এমন হয়েছে। আমি যখন ঢাকার নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি; তখন আমি যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, অর্থাৎ সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক আমাকে বলে বসলেন, সরকারি চাকরী পাচ্ছ না? দেখো চেষ্টা করে পাও কিনা!


অথচ আমি জীবনেও সেই অর্থে চিন্তা করিনি যে, আমাকে সরকারি চাকরী পেতেই হবে!


শুধু শিক্ষকরা না; আশপাশের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনরাও দেখবেন এই নিয়ে নিয়মিত কথা বলছে। অহরহ শুনেছি, বিয়ের বাজারে নাকি সরকারি চাকরীর আলাদা মূল্য আছে!


তো সমাজের মানুষজন সরকারি চাকরীকে এতো মূল্যায়ন করছে কেন?


কারণ, সরকারি চাকরী মানে সারা জীবনের নিশ্চয়তা, হাজারো অন্যায় করেও বহাল তবিয়তে চাকরী করে যাওয়া, কারো কারো জন্য ঘুষের নিশ্চয়তা, ক্ষমতার ইচ্ছে মতো প্রয়োগ ইত্যাদি!


এই হচ্ছে আমদের সমাজ এবং সমাজের মানুষজন! এরা এক দিকে বলবে সরকারি চাকরীর মানুষজন ঘুষ খায়, কোনো কাজ করে না, মানুষকে সম্মান দিতে জানে না ইত্যাদি! আবার এরাই আরেক দিকে গিয়ে নিজের সন্তান, বন্ধু-বান্ধব কিংবা আত্মীয়-স্বজনকে বলবে, তুমি সরকারি চাকরী পেলে না?


মাঝখান থেকে হাজারো তরুণ ছেলেপেলে সমাজের এসব চাপ সহ্য করতে না পেরে হয় মানসিক সমস্যায় জর্জরিত কিংবা শেষমেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুই ছাত্রের মতো আত্মহত্যাই করে বসছে!


এতোসব চাকরী, গাড়ি, বাড়ি, সামাজিক অবস্থান কিসের জন্য? জীবনের জন্য তো? এসবের পেছনে ছুটতে থেকে যদি মাঝখান থেকে জীবনটাই আর না থাকে, তাহলে? আমাদের সমাজ সরকারি চাকরী, গাড়ি, বাড়ি ইত্যাদি অর্জন করার কথা বলে। অথচ এসব ছাড়াও যে জীবনকে উপভোগ করা যায়, সেটা সমাজ আমাদের শেখায় না!


৩০ বছর বয়সের এই ছেলেটা হয়ত তার পুরো জীবনে একটা সরকারি চাকরীর পেছনে ছুটেছে; অথচ পৃথিবীর অপর প্রান্তে ১৮ বছরের বালক আবিষ্কার করছে কিভাবে রকেটে চড়ে স্পেসে যাওয়া যায় সহজ উপায়ে! কারণ তার সমাজ তাকে তার মতোই থাকতে দিয়েছে। তাই সে তার কাজ করেছে আনন্দসহকারে, জীবনকে উপভোগ করতে করতে!


আর আমরা?


আমরা আমাদের কাজ করি, সমাজ আমাদের যেভাবে করতে বলে! মেধাগুলো তাই আর বিকশিত হচ্ছে না। হারিয়ে যাচ্ছে অকালেই! এভাবেই আমরা মেধাহীন একটা সমাজে পরিণত হচ্ছি।


আমিনুল ইসলামের ফেসবুকথেকে


বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com