শিরোনাম
অল্পদিনেই মন জয় করে নিয়েছিল ফয়সাল
প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০১৮, ০০:১৯
অল্পদিনেই মন জয় করে নিয়েছিল ফয়সাল
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙ্গিয়ে নিজের ভাগ্য গড়ে অনেকে। আর ছেলেটি শুধু ছুটি নেবার জন্য ভাঙ্গালো প্রধানমন্ত্রীর নাম। আর সেই ছুটিই তার আজীবনের ছুটি হয়ে গেল।


ছেলেটি চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেলো আজ নয় দিন। কী উচ্ছল, প্রাণবন্ত ছিল। অফিস মাতিয়ে রাখতো ছুঁতো পেলেই। এই নয়দিনের প্রতিদিন আমি ছেলেটাকে অফিসে খুঁজে বেড়াই। অফিসে থাকলে আমার ছোট ছোট নানা কাজও করে দিত সে।


হারিয়ে যাওয়ার আগের দিন ১১ই মার্চও তার সাথে আমার কথা হয়েছে। সরাসরি নয়, মিঠুন মোস্তাফিজের মাধ্যমে। আমি তার খোঁজ করছিলাম। অফিসের এসাইনমেন্ট এডিটর মিঠুন জানালো, সে ছুটিতে আছে। বললাম, আমিতো তাকে ছুটি দেইনি, সে ছুটি পেলো কী করে? মিঠুন সাথে সাথে তার মোবাইলে ফোন করে আমার কথা বলে জানতে চাইলো, ছুটি পেলো কিভাবে? লাউড স্পিকারে থাকা ফোনে ওপার থেকে ছেলেটির কণ্ঠ শুনলাম, সে বলছে- আমি নারী দিবসের (৮ মার্চ) দিন ছুটি নিয়েছি। ঐদিন যারা বৈশাখী টেলিভিশনের সংবাদ বিভাগের নানা দায়িত্বে ছিলেন তাদের সবার কাছে যথাযথ আবেদন করেই সে ছুটি নিয়েছে।
বছরের এই একটি দিন আমাদের সংবাদ বিভাগের পুরো ব্যবস্থাপনা নারী সহকর্মীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়েছে সে, আর অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেছে প্রধানমন্ত্রীকে। কীভাবে সেটাই বলছি। আমি তাকে ছুটি দেবনা জেনেই নারী দিবসে নারী সহকর্মীদের হাতে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থাকায় ছুটি নেবার সময়টা বেছে নিয়েছে ৮ মার্চ।


আর আমি ১১ মার্চ মিঠুনের লাউড স্পিকারে রাখা ফোনে কথা বলার সময় বললাম তার ছুটি বাতিল করে দেব। তখন সে অনুনয় করে বললো- “মিঠুন ভাই আপনি একটু দাদাকে (আমাকে) বলেন, “এখন প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে (সিঙ্গাপুরে), ফলে আমার খুব একটা কাজ নেই রিপোর্টিংয়ের, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার আগে আমি কাজে যোগ দেবো আমার ছুটিটা বাতিল না করার জন্য দাদাকে বলেন।”পুরো কথোপকথনটা আমি শুনছিলাম লাউড স্পীকারে। প্রধানমন্ত্রীর অজুহাতটা শুনে আমি নমনীয় হয়ে গেলাম। কিন্তু ছুটি নেয়ার সময় এবং পরে কয়েক দফা আলাপচারিতায় সে আমাকে বা অন্য কোন সহকর্মীকে বলেনি যে, ছুটিতে সে দেশের বাইরে যাবে।


প্রধানমন্ত্রীর অজুহাত দিয়ে আমার কাছ থেকেও ছুটিটা নিয়ে গেল ছেলেটি। কিন্ত তার এবং তাদের কারণে প্রধানমন্ত্রীকে সফর সংক্ষিপ্ত করে ফিরে আসতে হলো তাদেরও আগে। ছেলেটি আগে ফিরতে পারলোনা, বরং হারিয়ে গেলো চিরতরে।


হারিয়ে যাওয়া সেই ছেলেটি হলো বৈশাখী টেলিভিশনের প্রতিবেদক আহমেদ ফয়সাল।


অল্পদিনে মন জয় করে নিয়েছিল সে। ২০১২ সালে প্রযোজনা বিভাগের কর্মী হিসেবে আমার দলভুক্ত হয় অফিসে। বছর দুয়েক পরে প্রযোজনা বিভাগের সিনিয়র কয়েক সহকর্মীর অনুরোধ ও তার আবেদনের ভিত্তিতে ফয়সালকে প্রতিবেদক করা হয়। অতি দ্রুত ভালো কাজের নজির তৈরি করায় বার্তা কক্ষের জ্যেষ্ঠ সহকর্মীদের নজর কাড়ে সে। শুরু থেকে কাজের প্রতি তাঁর দারুণ মনোযোগ ও একাগ্রতার কারণে সবার মন জয় করে। অন্যভাবে বললে, সে সবার ভালবাসা অর্জন করে নিয়েছিল। খবর সংগ্রহের বাইরে যে কোন অনুষ্ঠান আয়োজনে তার উৎসাহের কমতি ছিলনা কখনও। এমন প্রণবন্ত, উজ্জ্বল ও উচ্ছলতায় ভরা তরুণ যে আকস্মিকভাবে মর্মান্তিক উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাবে-এটা আমি সত্যিই ভাবতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, এখনই যেন ফয়সাল এসে আমাকে বলবে, “দাদা আমাকে কেন খোঁজ করছেন? বলেন কী করতে হবে?”


অনেকের মতো আমারও ভুল ভাংলো ফয়সাল, যখন আমার সামনে তোমার কফিনবন্দী নিথর দেহ দেয়া হলো গ্রহণ করবার জন্য। কাঠের বাক্সে মোড়ানো তোমার নিষ্প্রাণ দেহের সামনে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল বারবার। পড়তেই পারছিলাম না তোমার নামটা। তোমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গী করে তোমাকে নিয়ে আসলাম তোমারই দীর্ঘদিনের চেনা বৈশাখী টেলিভিশনের আঙ্গিনায়। মনে কত ভাবনা উঁকি দিলো। ভাবছি তুমি কী তা বুঝতে পারছো তোমার প্রিয় কর্মস্থলেই তোমাকে আমরা নিয়ে ফিরছি। মন চাইছিলো তোমাকে লিফটে করে ওপরে নিয়ে বার্তা কক্ষে যাই। তোমাকে দেখাই, তোমার শূণ্য চেয়ার টেবিল আমাদের জন্য কত বড় হাহাকার, তোমাকে দেখাই তোমার না থাকার খবর আমাদের কতটা ভারাক্রান্ত করেছে। খোলা শোকপত্র ভরে উঠেছে তোমার উদ্দেশ্যে লেখা ভালবাসার পংক্তিমালায়। সেসব কিছুই সম্ভব হলো না। বরং চোখের জলে বিদায় দিতে হলো তোমাকে।


প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙ্গিয়ে তোমার এই যাওয়া যে না ফেরার দেশে যাত্রা হবে, তা যদি জানতাম তাহলে তোমাকে ছুটি আমি কখনোই নিতে দিতাম না। আজ তোমাকে আমার এটুকুই বলবার আছে-যেখানেই থাকো ভালো থাকো, তোমার প্রতি আমার ভালবাসা থাকবে চির অমলিন।


অশোক চৌধুরীর ফেসবুক থেকে


বিবার্তা/নুর

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com