১৬ বছর আগের ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহরুল হক হলে মাত্র উঠেছি। আমরা প্রথম বর্ষের ছেলেরা তখন গণরুমে থাকি। হলের খাবার জঘন্য। প্রায়ই বন্ধুদের কোনো একজন বায়না ধরে বলে, চল আজকে তুই খাওয়াবি। এরপর সবাই দলবেঁধে বাইরে খেতে যাওয়া। কিন্তু ছোটখাটো গড়নের একটি ছেলে কখনোই আমাদের সঙ্গে যোগ দিতো না। আমি ওকে সেভাবে হলের নাস্তার দোকানেও দেখিনি। তবে মাঝে মধ্যে হলের ক্যান্টিনের খাবার খেতে দেখতাম।
একদিন কথা বললাম ওর সাথে দীর্ঘ সময় ধরে। শুনতে চাইলাম ওর কথাগুলো। জানলাম ওর বাবা রিকশা চালায়। খুব কষ্ট করে ও পড়াশোনা করছে। বাইরের খাবার খাওয়ার সাধ্য নেই। এমনকি নিয়মিত খাবারও সাধ্য নেই। আমার এতো মন খারাপ হলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের এমন অনেক ছেলেকে আমি চিনতাম যারা প্রচণ্ড কষ্ট করে লেখাপড়া করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও বিভিন্ন বর্ষের ভর্তির সময় আমি এমন অনেক ছেলেকেও পেতাম যাদের ভর্তির টাকাটাও নেই।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আমার এমন এক বন্ধু একদিন আমাকে বলেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে ও কোনো দিন সকালের নাস্তা করেনি। একবারে দুপুরে হলের ক্যান্টিনে খেতো। ও কিন্তু আজ খুব ভালো আছে।
আমি সবসময় মানুষের মধ্যে মানুষটাকে খুঁজে বেড়াতাম। সত্যি বলছি, আমি একটা সব থাকা ছেলে-মেয়ের চেয়ে নানা সংগ্রামে থাকা এই ছেলে-মেয়েগুলোর মধ্যে অনেক বেশি জীবনী শক্তি দেখতাম। আমি দেখেছি একটু সহানুভুতি একটু ছোঁয়া পেলে এরা পৃথিবী জয় করে ফেলতে পারে।
জীবনজয়ী এমন অনেককে আমি কাছ থেকে দেখেছি। তাদের কেউ আজ শিক্ষক, কেউ আজ বিসিএস ক্যাডার কেউ আরো ভালো কিছু করছে। গতকাল এমনি একজনের সাথে আনন্দ নিয়ে কথা বলছিলাম। বলছিলাম এবার তোকে বিয়ে দেবো। কিন্তু রাতটা না পেরুতেই আজ সকালে আরেকটা খবর দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তরুণ জীবনের কাছে হার মেনেছে। খবরটা দেখার পর নিজেকেও কিছুটা অপরাধী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ইশ... কোনোভাবে যদি ছেলেটাকে চিনতাম। তাহলে হয়তো ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে কোনো নির্মাণাধীন ছাদ থেকে লাফ দিয়ে তাকে আত্মহত্যা করতে হতো না। বারবার মনে হচ্ছে, যে ছেলেটি জীবন সংগ্রাম করে এতোদূর এসেছে, যে ছেলেটির আরো অনেক দূর যাওয়ার কথা, জীবনের মাঝপথ এসে জীবন থেকেই সে হারিয়ে গেল!
তরুণের এক বন্ধু ফেসবুকে লিখেছে, গণরুমে তরুণ ছিল সবচেয়ে নিরীহ। শৈশবে মা হারা অযত্নে বড় হওয়া এই ছেলেটি ২০১৫-১৬ সেশনে ভর্তি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্স বিভাগে। অর্থিক সংকটে জর্জরিত ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে নানা কারণে চরম হতাশায় ভুগতে শুরু করে। তার শারীরিক গঠন ও দেহের কালো রঙের কারণে অনেকের কাছেই সে যেন একটু বেশিই নিগৃহীত ছিলো।
তরুণের বন্ধুটি লিখছে, দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পরে তরুণ আমাকে অনেক অনুরোধ করেছিল, আমি যেন ওকে ভিসি স্যারের কাছে নিয়ে যাই এবং ওর সাবজেক্ট বদলের অনুরোধ করি! আমি হেসে বলেছিলাম, মানুষ ফিনান্স পায় না আর তুই পড়বি না! তাও আবার ২য় বর্ষে উঠে!
আমি বুঝি কেন একটা দরিদ্র ছেলে ফিনান্স ছাড়তে চায়। অনেক বই নোট ফটোকপি, বেশ খরচ। এর মধ্যে খাওয়া দাওয়া, নিজের খরচ যোগানো। হয়তো পরিবারকেও সাহায্য করতে হয়। কিন্তু সবচেয়ে মন খারাপ হয়েছে এই কথা শুনে ওর বন্ধুরা নাকি ওর কালো, দরিদ্র চেহারা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতো।
এই কথাটা আমাকে ভীষণ কষ্ট দিলো। আমরা কারো পাশে না দাঁড়াতে পারি, তাই বলে তার চেহারা, তার দারিদ্র্য নিয়ে হাসি তামাশা করবো? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি এতোটাই নিচে নেমে গেছে? কয়েকদিন আগে জাহাঙ্গীরেনগরে দেখলাম এক ছেলেকে এমনভাবে যন্ত্রণা দেয়া হয়েছে যে নিজের বাবাকেও চিনতে পারছে না।
আচ্ছা আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষকদের কতোজন খোঁজ নেন ছেলেমেয়েরা হলগুলোতে কী সংগ্রাম করে থাকে। আচ্ছা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ছাত্রদের দায়িত্বে থাকা শিক্ষকরা কতোটা সময় দেন তাদের ছাত্রদের? তারা কি জানেন প্রথম বর্ষ কেমন কাটে ছাত্রদের? শিক্ষকরা কি জানেন কেমন কাটে ছাত্রদের গণরুমে? হলের খাবার কেমন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বাদ দিলাম। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী যারা একটু ভালো আছে তারা কি কখনো একটু খোঁজ নেন অন্যদের? আপনি কি জানেন মাসে আপনি যে টাকার সিগারেট খান সেই টাকা দিয়ে হলগুলোতে অনেকের জীবন চলে? আপনারা যারা রাজনীতি করেন, হলগুলোর নেতা, তারা কি দরিদ্র ছেলেমেয়েগুলোর খোঁজ রাখেন? আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তরুণের জন্য।
তরুণের মৃত্যু যে কোনো বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষকে কষ্ট দেবে। আবার খুব বেশি আর্থিক কষ্ট না থাকলেও আমি কখনোই ধনী ছিলাম না। আজও নই। তবে একটা কথা বলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো ছেলে যদি মনে করেন আপনি দরিদ্র, আপনি হেরে যাবেন তাহলে বলি-আপনি ভুল ভাবছেন। প্লিজ জীবনের কাছে হারবেন না।
আপনারা যদি কেউ মনে করেন আপনার খাওয়ার ব্যাবস্থা নেই প্লিজ যোগাযোগ করবেন। দুনিয়ার কেউ আপনার নাম ঠিকানা জানবে না। ক্যাম্পাসে আপনার অন্তত তিনবেলা খাওয়ার ব্যাবস্থা হয়ে যাবে। আমি বিশ্বাস করি এই দেশের দরিদ্র প্রতিটি ছাত্রের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করার শক্তি আমাদের অন্তত আছে। অন্য কোন জরুরি সাহায্য দরকার হলেও কোনো না কোনো ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু দয়া করে জীবনের কাছে হারবেন না।
আপনারা যার নিজেদের অসহায় ভাবেন, এতিম ভাবেন তাদের বলি এই বাংলাদেশে আজকে আপনারা যাদের বড় দেখেন, বড় বড় সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী তাদের অনেকের জীবনের গল্পগুলো কষ্টের। কিন্তু তারা কেউ জীবনের কাছে হার মানেননি। বরং ঢাকায় যাদের বাড়ি-গাড়ি আছে তারাই অনেকে কিছু করতে পারেনি। বাংলাদেশের প্রতিটি ছাত্র প্রতিটি তরুণকে বলবো জীবনের কাছে হার মানবেন না। বুকে সাহস নিয়ে বলছি, আপনারা যদি মনে করেন আপনার কেউ নেই, আপনি এতিম, মনে করবেন আমি আছি। আবারো বলছি আমি বড়লোক নেই। কিন্তু বুক ভর্তি সাহস আছে। শুধু বলার জন্য বলা নয়, আমি দায়িত্ব নিচ্ছি। কোনো না কোনো ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
এবার আপনারা যারা ভালো আছেন, যারা আর্থিকভাবে কিছুটা হলেও সচ্ছল তাদের বলি মানুষ হয়ে যদি মানুষের পাশে না দাঁড়াতে পারেন সেই জীবন মানুষের নয়। কুকুর বেড়ালের জীবন। কাজেই মানুষের পাশে দাঁড়ান। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্রদের বলি আপনার আর্থিক অবস্থা যেমনি হোক। আপনার বন্ধু, আপনার পাশের ছেলেটির খোঁজ নিন। কখনো একটু সামান্য সাহায্য, একটু ভালোবাসা, একটু সহমর্মিতা আরেকজন মানুষকে নতুন জীবন দিতে পারে।
আর এই পুরো রাষ্ট্রকে বলি, দেশের হাজার হাজার শিক্ষক, ব্যবসায়ীসহ প্রতিটি সামর্থবান মানুষকে বলি, আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তরুণের মৃত্যু মানে মানুষ হিসেবে আমার আপনার পরাজয়। আপনাদের সবার হাতে পায়ে ধরে বলি চলুন আমরা আর পরাজিত না হই। বরং সম্মিলিত শক্তিতে চলুন সবাই সবাইকে নতুন জীবন দিই। ভালো থাকুক তরুণেরা। ভালো থাকুক বাংলাদেশ।
শরিফুল হাসানের ফেসবুক থেকে
বিবার্তা/কাফী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]