শিরোনাম
একবার অন্তত ভাবুন
প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৮:১১
একবার অন্তত ভাবুন
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

২০১০ সালের অক্টোবর মাসে, প্রায় ৮৭ বছর বয়সে ব্রেইনে স্ট্রোকে আমার বাবার মৃত্যুর কিছুদিন পর আমার মা নিজের অনেক কষ্টের কথার সাথে বললেন, ''দেখো, এখন আর আমার কোনো দাম নেই। কারণ আমি বিধবা। অপয়া বলে কেউ আমায় কোনো অনুষ্ঠানেও দাওয়াত দেবে না আর''।


আমি খানিকটা অবাক ও রাগান্বিত হয়ে বললাম, ''কেমন সব কথা বলছ মা! ৫৮ বছরের সংসা্রে নিজের চার-চারটে ছেলেমেয়ের সাথে আত্মীয়স্বজনদের এতোগুলো ছেলেপুলে মানুষ করলে, কতজনকে বিয়ে দিলে, কতজনকে কতোভাবে সাহায্য করলে। তুমি অপয়া হতে যাবে কোন দুঃখে?''


বাবার মৃত্যুর ২৫ দিনের মাথায় ধরা পড়লো আমার স্বামীর (৪৬ ) ব্রেইন ক্যান্সার, ''গ্লাইওব্লাস্টমা গ্রেড ৪'' । বাঁচার কোনো আশা নেই। ডাক্তার সোজা বলে দিলেন, ''বড়জোর ৮ থেকে ১৫ মাস''।


এর পর থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করা, সেই সাথে অবুঝ দুই শিশুসন্তানকেও। কিন্তু তখনও জানা ছিল না, মানুষ কতোটা স্বার্থপর,মিথ্যুক, ঈর্ষাপরায়ণ আর ছিদ্রান্বেষী হতে পারে, আমার জন্য ঠিক কতোটা বন্ধুর পথ অপেক্ষা করছে, জানা ছিল না বৈরী স্রোতে চলা অতোটা সহজ নয় ।


পরিবারে নিজের তিন ভাই, সাথে বড় চাচার দুই ছেলের সাথে সমানভাবে বেড়ে উঠেছি। নারী-পুরুষ ভেদাভেদ মানতে চাইনি কখনও। কিন্তু বিধবাদের না-মেনে বুঝি উপায় নেই। কারণ চারপাশের লোকজন আপনাকে দুঃখী দেখতে চায়, চায় কষ্টে আছেন দেখতে ।


এই তো ক'দিন আগে নিজেকে আধুনিক, প্রগতিশীল ও তথাকথিত নারীবাদী দাবিকারী জনৈক লেখিকার ফেসবুক বন্ধুর টাইমলাইনে দেখলাম অপর এক ''প্রগতিশীল'' নারী কমেন্ট করেছেন, ''কোন মুন্নি, বিধবা মুন্নি''? সেই বিখ্যাত নারীবাদী আবার সম্মতি জানিয়ে তাতে লাইক দিয়েছেন । হায়রে নারীবাদী নারী! তাঁদের চিন্তা-চেতনার দুরবস্থা দেখে নিজের মাথার চুলই ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। একে তো স্বামীর টাকায় সাজসজ্জার মাধ্যমে নিজেকে বাহারি পণ্যের চেহারায় উপস্থাপন করছে, অন্যের চোখকে আকৃষ্ট করতে চাইছে, উপরন্তু নাস্তিকতা প্রমাণ করতে যেয়ে অনেকে মদ খাওয়া আর যখন যার সাথে খুশী শয্যায় যাওয়াকেই আধুনিকতা, প্রগতিশীলতা মনে করছে । নিরীহ, শান্ত, গোবেচারা স্বামীটি জানতেও পারছে না নারীবাদের ছদ্মবেশে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী একের পর এক পরকীয়া চালিয়ে তাঁকে ঠকাচ্ছে ।


আমার এক বন্ধু একবার প্রশ্ন করলেন, ''আপনার নাকে নাকফুল, পরণে রঙিন শাড়ি । মানে বুঝলাম না।'' অবাক হবার ভান করে জিজ্ঞেস করলাম, কোরআন-হাদিসের কোথাও কি নিষেধ আছে? দয়া করে একটু জানাবেন প্লিজ! প্রয়োজনে আমি ১০০ বছর আগের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতো ন্যাড়া মাথা, ব্লাউজ-পেটিকোট ছাড়া কেবলই পাতলা সাদা ধূতি,গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরতেও রাজী আছি। কিন্তু সঠিকটা জানাতে হবে''।


স্বামীর পরিবারের কেউ একজন নাকি বলেছেন, ''আমি অপয়া হওয়ার কারণে আমার স্বামীর এই অকালমৃত্যু''। আমি বলেছি, ''আমি মেনে নেবো। কিন্তু আগে তাঁর নিজের মা, নিজের দুই ভাই আর বোনকে অপয়া বলতে হবে। কারণ, আমার থেকেও অল্প বয়সে তাঁদের আগে তাঁদের স্বামী ও স্ত্রীরা মারা গেছেন''।


অবাক হবার মতো ঘটনা ঘটলো সেদিন, যেদিন আমি জনৈক সংসদ সদস্যের সাথে টেলিফোনে কথা বললাম। সাংসদরা তাঁরা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন, জনগণের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ,কষ্ট বুঝেন বলেই না গণপ্রতিনিধি। কিন্তু তিনি প্রথমেই বলতে শুরু করলেন, ''দেখেন ভাবী, স্বামী ছাড়া একজন মহিলার জীবনের মূল্যই বা কি আছে, আপনার সবকিছুই ম্লান হয়ে যায় কারণ আপনি বিধবা''।


আমার বলতে ইচ্ছে হল, '' মহান সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা এবং উদ্দেশ্য বুঝার ক্ষমতা আমার-আপনার কারো নেই। কে জানে আপনার স্ত্রীও যে কোনো মুহূর্তে বিধবা হতে পারে। আপনার একমাত্র সন্তানটি কন্যা, বলা যায় না তাঁর ভবিষ্যৎ এবং ভাগ্যে কি আছে ''। কিছুই বললাম না, শান্ত ভাবে কেবল উত্তর করলাম, ''জী আপনি ঠিকই বলছেন, আমার জীবন একেবারেই মূল্যহীন''।


বুকে গ্যাসটিকের ব্যথাকে হার্ট অ্যাটাক মনে করে টিংকুকে (আমার মরহুম স্বামী) শিশুর মতো কাঁদতে দেখেছি, পরিবার-সন্তান সবকিছু ফেলে রেখে দিল্লী নিয়ে চিকিৎসা করাতে দেখেছি অথচ তিনি সময়ে ভোল পাল্টে ফেলেছেন। যেখানে স্বার্থ এখন সেখানেই তিনি এবং তাঁহারা । কঠোর এই পৃথিবীতে তিনি এবং তাঁহাদের অবস্থান আমার অনেক আগেই জানা হয়ে গেছে। কারণ একা পথে হাঁটতে গেলে ঘ্রাণশক্তি কুকুরের চেয়েও প্রবল হতে হয় । কেউ আমায় শিখিয়ে দেয়নি, চিনিয়ে দেয়নি কিন্তু নিজে নিজে বুঝে নিতে হয়েছে। হায়রে সংসদ সদস্য, হায়রে রাজনীতিবিদগণ, হায়রে মানবিকতা ! স্বার্থের বাতাসে সব নীতি-আদর্শের বুলি এক লহমায় পেঁজা তুলার মতো উড়ে যায় !!


ইদানীং জীবনের বাস্তবতায় প্রয়োজন, দায়িত্ব আর কর্তব্যের ভারে ভাবনা-চিন্তা, দুঃখ-কষ্ট, পাওয়া-না পাওয়াকে নিয়ে রেলিস করার মতো এতো বিলাসী সময় আমার হাতে নেই, তবুও কখনও সখনও উদাসী হাওয়ায় মন ব্যাকুল হয় আনমনেই ভাবি, ''সত্যিই কি আমি অপয়া?''


আমার কি কেবল স্বামীর দীর্ঘ জীবনের জন্যই প্রার্থনা করার কথা ছিল? অপারগতায় নিজেকে সতী প্রমাণ করার জন্য স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় আত্মাহুতি দেওয়ার কথা ছিল? নিদেনপক্ষে আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে সময়-অসময়ে কেঁদে-কেটে সবার মনবাসনা এবং গভীর চাওয়াকে তৃপ্ত করার কথা ছিল!


তবে আমার দুই শিশু সন্তান, বিছানায় শয্যাশায়ী আমার অসহায় বৃদ্ধা মা, আমাকে ঘিরে চারিপাশের আরও অনেক অসহায় মুখ তাঁদের কি হতো? একজন নারীর জন্ম কি কেবলই একজন পুরুষকে ঘিরেই? নারী কি কোনোদিনও মানুষ হয়ে উঠতে পারবে না?


আধুনিক প্রগতিশীল দাবী করা নারীটিকে বলি, ভোটবিহীন নির্বাচিত সংসদ সদস্যকে বলি, স্বামীর পরিবারের লোকটিকে বলি, নাকফুল আর রঙিন শাড়ি নিয়ে প্রশ্ন তোলা বন্ধুবেশী সেই শত্রুকে বলি, কো্নো মন্তব্য বা সমালোচনা করার আগে আমার জায়গায় নিজেকে ফেলে একবার অন্তত ভাবুন, দিনক্ষণ ঠিক জেনে ক্যান্সারাক্রান্ত মানুষটির সাথে প্রতিমুহূর্তের শ্বাস নেয়ার কষ্ট আর অসহায়ত্ব বুঝতে পারবেন, স্বামী বা স্ত্রী হারানোর বেদনা বুঝতে পারবেন, অবোধ শিশুকে একা হাতে মানুষের মতো মানুষ করার সংগ্রাম দেখতে পাবেন, ক্লান্তিহীন লড়ে যাওয়া আর পরিশ্রম দেখতে পাবেন, আমার সততা, একাগ্রতা জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং প্রতিশ্রুতি দেখতে পাবেন।


প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর ৪৬ বছরের কর্মক্ষম যুবক যখন জানতে পারলো মৃত্যু তাঁর দুয়ারে কড়া নাড়ছে, তাঁকে নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার সাহস আর শক্তি জোগানো সঙ্গী হওয়া এতোটাই কি সহজ ছিল ! একা মা হিসেবে আপনাদের মত অবিবেচকে ভরপুর সমাজে একা পথ হাঁটা এতোটাই কি সহজ !


শ্রদ্ধার আসনে বসা আপনার মহীয়সী মা, স্নেহের বোন, ভালোবাসার স্ত্রী, আদরের কন্যা হলেও কি আমার মতো সমালোচনায় ক্ষতবিক্ষত করতেন, নাকি গর্বে সম্মানে তাঁর সামনে নিজের মাথা নোয়াতেন - একবার অন্তত ভাবুন।



বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com