শিরোনাম
এক দুঃখিনী নারীর জীবন
প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৮:০৭
এক দুঃখিনী নারীর জীবন
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

ক'দিন আগে গত হলেন আমার বড় ফুফু। নব্বইয়ের মতো বয়স হয়েছিল। বয়সের কারণে অসুস্থ ছিলেন। আমি ডিসেম্বরের শেষ দিকে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে পেয়ে পরম মমতায় আমার হাত ধরে ছিলেন। কথা বলার তেমন শক্তি না-থাকা সত্ত্বেও কথা বলেছেন। আজ আমার তাঁর জীবনের কিছু কথা সবার সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে।


ফুফু ছিলেন আমার দাদা-দাদীর বড় সন্তান। অসম্ভব সুন্দরী ছিলেন। কিন্তু অপরূপ সৌন্দর্যের হাত ধরে তার জীবনে সৌভাগ্য আসেনি। বার বার সুখের দেখা পেলেও তা ছিল আলেয়ার মতো ক্ষণস্থায়ী। সে-গল্পই বলছি।


দাদা সেকালেও ফুফুকে কোরআন-হাদীসের পাশাপাশি অল্পবিস্তর বাংলা-ইংরেজি শিখিয়েছিলেন। পরে তিনি এক ব্যবসায়ীর সাথে ফুফুর বিয়ে দেন। ফুফু একে একে চার কন্যার মা হন। ফুপা অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। শুনেছি খুব সুখের সংসার ছিল তাঁদের । একদিন ফুপার ব্যবসায়িক পার্টনার মাছের মাথার সাথে বিষ মিশিয়ে ফুপাকে খাওয়ালে ফুপার অকালমৃত্যু ঘটে আর সেই সাথে শুরু হয় ফুফুর কঠিন পথ চলা।


ফুফুকে চার মেয়েসহ ( নুূরজাহান, নূরনাহার শামশুননাহার ও রোকেয়া) আমার দাদা নিয়ে এলেন। দাদার পাঁচ মেয়ে, এক ছেলে (আমার বাবা)। সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আমার দাদা। আমার বাবা তখন সম্ভবত কলেজে পড়েন। দাদা ছিলেন আলেম। শিক্ষকতার বেতন আর জমিজমা থেকে যা ইনকাম হতো তা দিয়েই সংসার চলতো। দাদী অসুস্থ ছিলেন। চোখেও কম দেখতেন। সবমিলিয়ে দাদার করুণ অবস্থা।


ফুফুর বয়স কম ছিল। দাদা ফুফুকে আবার বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এবারও দাদা এক ব্যবসায়ীর সাথে ফুফুর বিয়ে ঠিক করলেন। ছেলেরও দ্বিতীয় বিয়ে। স্ত্রী মারা গেছে। তাঁর এক ছেলে তিন মেয়ে।


ফুফুর চার মেয়েকে নিজের কাছে রেখে ফুফুকে বিয়ে দিয়ে দিলেন দাদা। চার শিশুসন্তানকে বাবার বাড়িতে রেখে আমার অসহায় ফুফু অচেনা এক সংসারের পথে পা বাড়ালেন। সেদিন তার মনের অবস্থা কী হয়েছিল, কল্পনা করতেও শিউরে উঠি।


বিয়ের পর দেখা গেল, ফুপার আগের স্ত্রী মারা যাননি, বর্তমান আছেন। প্রথম স্ত্রীর সম্মতি নিয়েই ফুপা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। ওই স্ত্রী অতি সহজসরল বা একটু বোকাসোকা ছিলেন বলে ফুপা আবার বিয়ে করেন ! এমন পরিস্থিতিতে পড়ে ফুফু বিচলিত হলেও একপর্যায়ে ভাগ্যকে মেনে নেন। অবিশ্বাস্য হলেও ফুফুর সতীনও ফুফুকে আপন করে নেন। আমার বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে এই দু'সতীনের মধুর সম্পর্ক দেখেছি। আমার জীবনে সতীনে সতীনে এমন ভাব আর কোনোদিন দেখিনি। দু'জন মিলে আমাদের বাড়িতে নাইয়র আসতেন। ফুফুর সাথে তিনিও আমার বাবাকে ভাই ডাকতেন। আমার বাবাও তাঁকে বুবু ডাকতেন।


এই সংসারে আমার ফুফুর দুই ছেলের জন্ম হয়। দুই সতীনের ছেলেমেয়েদের মাঝেও অদ্ভুত মিল ছিল।


নতুন ফুপা বিশাল সম্পদের মালিক ছিলেন। তবে একটু কিপটে ছিলেন। মোটের ওপর ফুফুর সংসার বেশ ভালোই চলছিল। এতে আমার দাদা-দাদী কিছুটা স্বস্তি পেলেও ফুফুর ছোট ছোট চার মেয়ে নিয়ে তারা অথৈ সাগরে পড়ে গেলেন। কে তাদের দেখাশোনা করবে?


আমার অন্য ফুফুদেরও তখন বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের মাঝে সবার ছোট ফুফুর মানসিক সমস্যা দেখা দেয়ার কারণে শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এসেছে। দাদীও অসুস্থ। এ অবস্থায় দাদা মনস্থির করলেন ফুফুর ছোট দুই মেয়েকে দত্তক দিয়ে দেবেন।


কিন্তু দাদার এই পরিকল্পনায় বাদ সাধলেন আমার বাবা। তিনি কিছুতেই দাদাকে এই কাজ করতে দেবেন না। তখন দাদা আমার বাবার শহরে চলে যাওয়ার অপেক্ষায় রইলেন। বাবা যখন চলে গেলেন দাদা তখন ছোট দুইজনকে দত্তক দিয়ে দিলেন।


একদিন আমার বাবা কোনো কারণ ছাড়াই বাড়িতে এসে হাজির। পাগলের মতো খুঁজতে লাগলেন তাঁর আদরের ভাগ্নিদের। দাদা তাঁর ব্যর্থতার কথা বললেন (আমার চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে। ঐ দৃশ্য কল্পনা করতে পারছি না)। তখন বাবা নাকি দাদাকে বলেছিলেন, 'বাপজান, তুমি অন্ততপক্ষে আমার শামশুননাহারকে এনে দাও।' শামশুননাহার ছিল ফুফুর তিন নাম্বার মেয়ে। তখন নাকি সে আধো আধো কথা বলতে পারতো। তাকে ফিরিয়ে এনে আমার বাবার কোলে দেয়া হলো।


একদিন দুপুরে শামশুন নাহারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। আমাদের বাড়ির দু'পাশে দু'টি পুকুর ছিল। খোঁজা হলো পুকুরে। অবশেষে পুকুরেই আমার বাবার প্রাণের শামশুকে প্রাণহীন অবস্থায় পাওয়া যায়।


এ ঘটনার পর আমার বাবা নাকি অনেকদিন পাগলের মতো আচরণ করেছিলেন। ফুফুর অবস্থা কী বলবো, সেটা বর্ণনা করার শক্তি আমার নেই।


ছোটজনকেও (রোকেয়া) ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা বাবার ছিল। পরে আর সাহস করেননি। ছোটজন বড় হওয়ার পর আমাদের বাড়িতে আসতেন, এখনো আসেন।


একসময় বাবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে একটা কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পরিবারের হাল ধরেন। বাবা আর দাদা মিলে আমার ফুফাতো বোনদের বিয়েশাদি দেন। আমার দাদার সংসার প্রাণ ফিরে পায়।


এর মাঝে একদিন খবর আসে, আমার বড় ফুপা মারা গেছেন (ফুফুর দ্বিতীয় স্বামী)। আমার ফুফুর জীবনে আবার নেমে আসে ঘোর অমানিশা। ফুফুর দুই ছেলে তখনো স্কুলের পাঠ শেষ করেনি। ফুপা মারা যাওয়ার পর তারা পড়ালেখা একরকম বন্ধ করে দেয়। ফুফু এবং আমার বাবার হাজার চেষ্টায়ও তাদের আর পড়ামুখো করানো সম্ভব হয়নি। ফুপার মৃত্যুর পর ওরা ''স্বাধীন'' হয়ে যায়! বয়স কম থাকাতে তারা তাদের বাবার ব্যবসাও দেখাশোনা করতে পারছিল না। এদিকে সংসারে খরচপাতি আছে। তাই তারা ফুপার দোকান এবং জায়গা বিক্রি করা শুরু করলো। এখন আর কিছু অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না।


দুনিয়ায় কতকিছুর পরিবর্তন হলো। কতো জনের ভাগ্য ফিরল। আমার অভাগী ফুফুর ভাগ্য কখনো ফেরেনি। তিনি তার সন্তানদের শিক্ষিত করতে পারেননি। স্বামীর সম্পত্তি ধরে রাখতে পারেননি বলে কতো মানুষ তাঁকে গালমন্দ করেছে। আমি ভেবে পাই না, একজন স্বল্পশিক্ষিত বিধবা কী করতে পারতেন! তাঁর পুরো জীবনটাই তো ট্রাজেডিতে ভরা। তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন কাঁদতে কাঁদতে, যেতেনও কাঁদতে কাঁদতে। তখন তাঁর কান্নার কারণ বুঝতাম না, এখন বুঝি। তাঁর কত কষ্ট ছিল। আমার বাবার সাথে তাঁর সব কষ্ট শেয়ার করতেন। বাবাও যথাসাধ্য সহযোগিতা করতেন।


তবে হ্যাঁ, আমার ফুফুর পারিবারিক বন্ধন এখনো অটুট আছে। ছেলেরা, এমনকি তার ছেলের বউরা কখনো তার অবাধ্য হয়নি। তাঁর এক ছেলে পারিবারিক চাহিদা মেটানোর জন্য বিদেশে। আরেক ছেলে তার কাছে থেকে সেবাশুশ্রূষা করেছে। মেয়েরা ছিল ফুফুর প্রাণ। তাঁর দুই সংসার এবং তার স্বামীর আগের সংসারের মাঝে এখনো আগের মতোই সম্পর্ক অটুট আছে। তিনি সবাইকে ভালোবাসতেন। জীবনের শেষ সময়ে তিনিও সবার ভালোবাসা পেয়েছেন। আমি মনে করি আমার ফুফুর সার্থকতা এখানেই।


ফুফুর মেয়েদের কাছে তাদের জীবনের করুণ কাহিনী শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। ফুফুর হৃদয়ে লেখা কষ্টগুলো পড়তে চেষ্টা করতাম। জীবনের এই অপরাহ্নে এসে বারবার পড়া কোনো এক উপন্যাসের পাতা আবারো উল্টিয়ে দেখি, যেখানে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত লিখা আছে এক করুণ উপাখ্যান। আমার ফুফু যদি সাহিত্যিক হতেন তাহলে তিনি নিজের জীবনী লিখে যেতে পারতেন। তিনি তা পারেননি, তাই অখ্যাত ফুফুকে নিয়ে তার অখ্যাত ভাইঝির কিছু লেখার এ অক্ষম চেষ্টা। কারণ, এ তো শুধু আমার ফুফুর জীবনকথামাত্র নয়, এ যে হাজারো গ্রামীণ বাঙালি নারীরই জীবনোপাখ্যান !!


আফরোজা লিলি'র ফেসবুক থেকে


বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com