শিরোনাম
শ্বেতাঙ্গ ''সভ্যতার'' কুৎসিত চেহারা
প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৬:৩৯
শ্বেতাঙ্গ ''সভ্যতার'' কুৎসিত চেহারা
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

মাস ছয়েক আগে যখন নাইজেরিয়া থেকে আসা ছেলেটার ইন্টারভিউ নিচ্ছিলাম, তখন তার চোখে-মুখে দেখেছিলাম আগামীর স্বপ্ন। আমি যখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি কেন দেশের বাইরে মাস্টার্স করতে চাইছো? কেন নিজ দেশে নয়?


-একটা ইউরোপিয়ান মাস্টার্স ডিগ্রী থাকলে দেশে ফিরে গিয়ে ভালো কিছু করতে পারব। নাইজেরিয়াতে ইউরোপিয়ান ডিগ্রীর একটা আলাদা মূল্য আছে।


আমি ছেলেটাকে অ্যাডমিশন দেয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলাম।


স্বপ্নের ইউরোপে পড়তে এসেছে মাসছয়েক হয়ে গেছে। গতকাল ছেলেটা আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলো। আমি সময় করে উঠতে পারিনি। আজ যখন সময় হলো, দেখি তার মন ভীষণ খারাপ। জিজ্ঞেস করলাম, তোমার মন খারাপ কেন? কাল কথা বলতে পারিনি বলে?


খানিক সময় চুপ থেকে বলল, তুমি কি আজকের পত্রিকা পড়েছ?


-না, পড়ার সুযোগ হয়নি।


এরপর ছেলেটা যা বর্ণনা করল, আমি অবশ্য শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না! ছেলেটি বললো, গতকাল আমি ও আমার আরেক নাইজেরিয়ান বন্ধু বাসে করে শপিং মল থেকে ফিরছিলাম। এক হোয়াইট (সাদা) লোক, বয়স ত্রিশের মতো হবে, পাশের সিটে বসা ছিল; হঠাৎ করে আমার বন্ধুর মুখে থুতু ছুড়ে মেরেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ''তুমি থুতু ছুড়ে মারলে কেন?'' এরপর ওই হোয়াইট লোকটি আমাদের ''ব্ল্যাক, নিগ্রো'' বলতে বলতে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইচ্ছে মতো কিল-ঘুষি মারতে থাকে।


আমি জিজ্ঞেস করলাম, বাসের অন্য যাত্রীরা কেউ কিছু বলেনি?


-না, কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি।


-তুমি এরপর কি করলে?


এক পর্যায়ে দেখি ওই লোক পকেট থেকে ছুরি বের করে আমাদের মারতে আসছে। তখন আমরা দ্রুত বাস থেকে নেমে গিয়ে পুলিশকে ফোন করেছি। পুলিশ এরপর বাসের ভেতর গিয়ে লোকটাকে গ্রেফতার করেছে।


আমি এরপর পত্রিকায় খবরটা পড়লাম। অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, স্থানীয় পত্রিকায় ঘটনাটা এমনভাবে লিখেছে, তাতে করে মনে হচ্ছে বাসের অন্য যাত্রীরা ওই ঘটনার প্রতিবাদ করেছে। অথচ আমার এই ছাত্র বলছে, কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি।


বিভাগীয় প্রধান হিসেবে এই ধরনের পরিস্থিতিতে কি বলতে হয় আমার ঠিক জানা নেই। আমি কেবল তাকে বললাম, আমি খুবই দুঃখিত তোমাকে এমন একটা পরিস্থিতির মাঝ দিয়ে যেতে হলো। তবে এ ধরনের ঘটনা এইসব দেশে বিরল। তুমি এটাকে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবতে পারো।


এরপর যতটুকু সান্তনা দেয়া সম্ভব দিয়ে বললাম, তোমার জন্য শুভ কামনা থাকল।


ছেলেটা রুম থেকে চলে যাবার পর মনে হলো, আমার এই ছাত্রকে বলা হয়নি, এই একই কাজ যদি তুমি করতে, বাসের মাঝে কারো উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে কিংবা ছুরি বের করে মারতে উদ্যত হতে, তাহলে তোমাকে ওরা আখ্যা দিত টেরোরিস্ট কিংবা সন্ত্রাসী হিসেবে। এই দেশ ছাপিয়ে পুরো পৃথিবীর সংবাদমাধ্যমে হয়ত এই খবর ছাপা হতো। খুঁজতে শুরু করতো তোমার সঙ্গে কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের যোগাযোগ আছে কিনা। অথচ যেই লোক তোমাদের মুখে থুতু ছিটিয়েছে, ছুরি নিয়ে মারতে উদ্যত হয়েছে, কেবলমাত্র তোমাদের গায়ের চামড়া কালো বলে, তাকে পত্রিকাগুলো ''মাতাল'' বলছে!


কিছুক্ষণ আগে আমি এই ছেলেটার একটা মেইল পেয়েছি। লিখেছে, স্যার, আমি নাইজেরিয়া যাবো মাসখানিকের জন্য। আমার চাচা খুব অসুস্থ, তাই তাকে দেখতে যেতে হবে। আমার প্লেনের টিকেটটা এই মেইলের সঙ্গে যুক্ত করে দিলাম।


আমি এই ছেলের মেইলটা পড়ে এই লেখা লিখতে বসেছি। দুপুরেও তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তখন যাবার কথা কিছু বলেনি। হঠাৎ মেইল পেয়ে বুঝতে পারছি, হয়ত সে একটা মানসিক ট্রমার মাঝ দিয়ে যাচ্ছে। কিছুটা বিশ্রাম হয়ত দরকার প্রিয়জনের আশপাশে থেকে। তবে অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, এতো কিছুর পরও ছেলেটা এই দেশ, সমাজ কিংবা মানুষগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ না করে বরং নিজের চাচা অসুস্থ, এটা বলে দেশে যেতে চাইছে।


এরপরও সাদা চামড়ার মানুষগুলো হয়ে যায় সভ্য, আর কালো চামড়ার এই আমরা থেকে যাই অস্পৃশ্য, অসভ্য হিসেব! আর থাকবো না-ই বা কেন? এই আমরাই তো ভাবি, ইউরোপ-আমেরিকার ডিগ্রী মানে বিশাল কিছু! এই আমরাই তো বিদেশে এসে সাদা চামড়ার মানুষ দেখলে আলাদা দাম দেই, আর কোনোভাবে যদি সাদা চামড়ার কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব কিংবা ভাব জমানো যায়, এই আমরাই আবার তাকে আলাদা মূল্যায়ন করি!


ঔপনিবেশিকতা অনেক আগে বিলীন হয়েছে! দাস প্রথাও এখন আর নেই। শুনেছি পৃথিবীও নাকি আগের চাইতে অনেক সভ্য হয়েছে।


আমি তো আমার চারদিকে এখনো মানুষ বেচা-কেনার মিছিল দেখতে পাই। রাতের অন্ধকারে নয়, প্রকাশ্য দিবালোকে প্রতিদিন আমি দেখি কিংবা অনুভব করি, সভ্য থিসেবে পরিচিত মানুষগুলো কত সহজেই না বিকাচ্ছে আর রঙ বদলাচ্ছে! বেঁচে থাকার জন্য, নিজেদের "বড়" হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মানুষ নামের হিংস্র পশু গুলো নিজেদেরই দিনে-রাতে বাজার দরে বিক্রি করছে; এরপরও তারা নিজদের সভ্য বলে দাবি করছে!


আমিনুল ইসলামের ফেসবুক থেকে


বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com