শিরোনাম
মায়ের মতো আপন কেহ নাই
প্রকাশ : ৩০ জানুয়ারি ২০১৮, ১৮:২৪
মায়ের মতো আপন কেহ নাই
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

আমার মায়ের বিয়ে হয় ১২ বছর বয়সে। আমার বড় বোনের যখন জন্ম হয়, মায়ের বয়স তখন ১৪ বছর। শেষ সন্তান হিসেবে আমার যখন জন্ম হয়, ততদিনে আমার মা আরও পাঁচ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন।


এতো কম বয়েসে বিয়ে আর এতোগুলো সন্তান জন্ম দেয়ার পর যে কোনো মেয়ের পক্ষে সন্তানদের ঠিকমতো লালন-পালন করা কঠিন হওয়ার কথা। সে সঙ্গে তার যদি লেখাপড়া কিংবা অক্ষরজ্ঞান না থাকে, তাহলে তো ব্যাপারটা আরও কঠিন হয়ে যাওয়ার কথা! এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শেষ সন্তান হিসেবে এমন এক ছেলের, যে আসলে ঠিক স্বাভাবিক হিসেবে জন্ম নেয়নি।


ডাক্তাররা বললেন, আপনাদের এই ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়ে মনে হয় না লাভ হবে। সে হয়তো সবার সঙ্গে একই পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারবে না; তার চাইতে আপনারা ওকে বাড়িতে রেখেই যা শেখানোর শেখাতে পারেন।


বাবার কাছে গিয়ে আমার মা বললেন, আমি আমার ছেলেকে স্কুলে পাঠাবোই। দরকার হয় আমি নিজে রোজ স্কুলে যাবো ওর সঙ্গে।


বাবা শেষ পর্যন্ত মায়ের কথা ফেলতে পারলেন না। তাদের ছোট ছেলেকে স্কুলে পাঠানো হলো।


স্কুলে আমি কোনো কিছু ঠিকমতো মানিয়ে নিতে পারি না। একটু কিছু দেখলেই কেঁপে উঠে কিংবা কোনো পড়াই ভালোভাবে ধরতে পারি না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো পিঠাপিঠি বড় বোন সঙ্গে স্কুলে যাবে, ভাইয়ের পড়াগুলো সে-ই উঠিয়ে নিয়ে আসবে।


বড় বোন জানালার ফাঁক দিয়ে পড়া তুলছে আর ছোট ভাই ক্লাসরুম থেকে ওর বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। স্কুলের ক্লাসমেটরা এই দৃশ্য দেখে হাসাহাসি করতো।


অনেক বড় হওয়া পর্যন্তই এমনটা চলতে থাকলো। কিন্তু একটা সময় দেখা গেলো, এই ছেলে ঠিকই পড়াশুনা নিজে নিজে একটু একটু করে ধরতে পারছে, অন্য সবার সঙ্গেও খুব ভালোভাবে না হোক, একটু একটু করে মানিয়ে নিতে পারছে।


এভাবেই আমার মায়ের ছোট ছেলে স্কুল- কলেজ পাস করে ফেলল। মায়ের আনন্দ দেখে কে! বাবার কাছে গিয়ে আমার মা বলল, সেদিন যদি ডাক্তার আর তোমাদের কথা শুনে হাল ছেড়ে দিতাম, তাহলে আমার এই ছেলে তো সমাজের কাছে মূর্খই থেকে যেত।


বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় হলো। ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে, কিন্তু সে সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায়। কারণ, সে ঘর থেকে বের হয়ে বাইরের জগত সম্পর্কে জানতে চায়। সেই সঙ্গে চায় নিজের মতো করে পৃথিবীটাকে চিনতে।


কিন্তু বাবা রাজি হচ্ছে না। তার একটাই কথা, আমার এই ছেলে তো একা গিয়ে কোথাও মানিয়ে নিতে পারবে না। ওর ঢাকাতে আমাদের সবার সঙ্গেই থাকা ভালো। কী দরকার অন্য জায়গায় যাবার!


আমার মা সোজা গিয়ে বললেন, না, আমি চাই আমার এই ছেলে নিজের পায়ে দাঁড়াক। সবাই যাকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছে, দেখবে সে-ই একদিন এমন কিছু করবে, যার জন্য আমরা সবাই গর্ব করবো।


এরপর মা তার ছোট ছেলের কাছে গিয়ে বললেন, তোমার যা করতে ইচ্ছে করবে, সেটাই করবে। তোমার সিলেট যেতে ইচ্ছে করছে, তুমি অবশ্যই যাবে। শুধু মনে রাখবে, পৃথিবীর মানুষকে ভালবাসতে হবে, তাহলে তারাও তোমাকে ভালোবাসবে। আমি জানি, বড় হতে হতে অনেক মানুষ তোমাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছে, কিন্তু এও তো সত্য, অনেক মানুষ তোমাকে ভালোবাসা দিয়েছে। তাই সবসময় সকল মানুষকে ভালবাসবে। সবাইকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করবে। তাহলে দেখবে মানুষজনও তোমাকে ভালবাসছে।


তবুও বাবা-মায়ের মনে হয়েছে, এই ছেলে কি শেষ পর্যন্ত পারবে একা একা একটা শহরে গিয়ে সব কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে পড়াশুনা করতে! একটা সময় দেখা গেলো ছেলে ঠিকই ভালোভাবে পাস করে ফেলেছে।


বাবার চোখে তো রাজ্যের বিস্ময়! তবে মা খুব সহজভাবে নিলেন এবং বললেন, আমি জানতাম ও পারবে।


সেই ছেলে একদিন বিদেশে পড়ার জন্য বায়না ধরলো। সুইডেনে পড়তে যেতে চায়। বাবা এবারও বললেন, কী দরকার এতো বিদেশে গিয়ে। এর চাইতে আমাদের আশপাশে থাকো। আমরা তোমাকে দেখে রাখতে পারবো। অন্য কেউ হলে কথা ছিল। তোমার বিদেশে গিয়ে কাজ নেই।


মা বললেন, না, ও যাবে। ও যা চায়, ওকে সেটা করতে দাও।


বাবা আর ‘না’ করলেন না।


বাবা-মার ছোট সন্তান, যে কিনা জন্মেছে অন্য আর দশজন স্বাভাবিক সন্তানের মতো না; যাকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই সবার; সেই ছেলে অস্বাভাবিকতাকে সঙ্গে নিয়েই দেশের পড়াশুনা শেষ করে, বিদেশে মাস্টার্স, পিএইচডি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছে।


মায়ের খুশি দেখে কে! গর্ব করে স্বামীর কাছে গিয়ে বলছে, দেখেছ, আমি বলেছিলাম না, আমার এই ছেলেই এক দিন এমন কিছু করবে যা অন্যরা পারবে না।


একটা সময় ছেলেটির মায়ের শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়লো। বাংলাদেশের ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিলেন। দেশে থাকা তার পাঁচ সন্তান কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। ছোট ছেলে যখন জানতে পারলো, সে সিদ্ধান্ত নিলো তাকে ইউরোপে চিকিৎসা করাবে।


কিন্তু এই ছেলে যে একা থাকে! সে কি পারবে চাকরী করে, অসুস্থ মায়ের দেখাশুনা আর চিকিৎসা করাতে! অন্য ভাই-বোনরা রাজি হচ্ছে না। মা'ও বললেন, থাক, আর বিদেশে গিয়ে কি হবে। অনেক খরচেরও ব্যাপার। থাক, যে ক’টা দিন বাঁচি দেশেই থাকি।


তার ছোট ছেলে তখন বলল, মা, আজ থেকে বছর ত্রিশ আগে যদি তুমি হাল ছেড়ে দিতে, তাহলে কি আজ আমি এতদূর পর্যন্ত আসতে পারতাম? তুমিই তো শিখিয়েছ কোনোভাবে হাল ছাড়া যাবে না।


মা চোখ বড় বড় করে বললেন, টিকেট কাটো। আমি একাই যাবো তোমার ওখানে।


বিদেশ বিভূঁইয়ে শুরু হলো ক্যান্সারে আক্রান্ত মা আর ছেলের যুদ্ধ। ছেলে এক হাতেই মায়ের জন্য রান্না, মায়ের কেমোথেরাপি, অপারেশন, দেখভাল, অফিস - সব করছে।


একটা সময় দেখা গেলো মা কিছুটা সুস্থ হলেন। দেশের চিকিৎসকরা যেখানে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেখানে মা কিছুটা হলেও সুস্থ হয়ে দেশে ফেরত গেলেন সাত মাস বিদেশে থাকার পর। মা-ছেলের প্রাথমিক যুদ্ধটা অন্তত জেতা হলো। মা যখন বিদেশ থেকে দেশের উদ্দেশে রওনা হচ্ছেন, তখন তার ছেলেকে বলে গিয়েছেন, তুই আমার ছেলে না, তুই একই সঙ্গে আমার ছেলে এবং মেয়ে।


বছরখানেক দেশে সুস্থ থাকার পর আবার শরীরটা কিছুটা খারাপ করলে, আবার বিদেশে যেতে হলো মাকে তার ছেলের কাছে। আবারও যুদ্ধ। এই যুদ্ধ করতে করতেই খবর এল, দেশে তার অসুস্থ স্বামী অর্থাৎ ছেলের বাবা মারা গেছেন। এই ছোট ছেলের উপরই দায়িত্ব পড়লো সংবাদটি মাকে দেয়ার।


ক্যান্সারে আক্রান্ত অসুস্থ মাকে যখন ছেলে বাবার মৃত্যুসংবাদ দিচ্ছে, ততক্ষণে ছেলের চোখেই অশ্রু। সেই অশ্রু দেখে মা বললেন, মানুষের মৃত্যু তো স্বাভাবিক ব্যাপার। তোমার বাবার অনেক বয়েস হয়েছিলো। এক সময় না একসময় তো মানুষকে মরতে হবেই। তুমি একদম মন খারাপ করবে না। তোমার বাবা সফল জীবন কাটিয়ে গেছে, এটা ভেবে বরং আনন্দিত হবে।


একটা সময় মায়ের আবার দেশে যাবার সময় হলো। এবার অবশ্য পুরোপুরি সুস্থ হয়ে আর যাওয়া হয়নি। বিদেশে থাকতে মায়ের হাঁসফাঁস লাগছিলো, তাই তিনি আর থাকতে চাইছিলেন না। শেষমেশ বাধ্য হয়েই দেশের টিকেট কেটে দিতে হলো।


যখন দেশ থেকে জানতে পারলাম, আমার মায়ের শরীরটা খুব খারাপ করেছে, সঙ্গে সঙ্গেই ফোন করে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি। কিন্তু কথা বলার অবস্থায় তিনি ছিলেন না।


দীর্ঘ অপেক্ষার পর, মা যখন কথা বলতে পারলেন, তিনি প্রথম যেই কথা বললেন, সেটা হচ্ছে, আমি টুটুলের (তার ছোট ছেলে, মানে আমি) সঙ্গে কথা বলতে চাই।


স্কাইপেতে যখন মায়ের সঙ্গে কথা বলছি, আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি, চোখের পানি যেন কোনোভাবেই মা দেখতে না পায়। মা খুব আস্তে আস্তে বললেন, কেমন আছো তুমি?


-আমি ভালো আছি মা।


-কই, তোমার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে না ভালো আছো তুমি!


- তুমি তোমার এই শরীরে নিজের কথা চিন্তা না করে, আমার কথা চিন্তা করছ মা!


-টুটুল, আমি আর ক’দিন বাঁচবো জানি না। তোমাকে ছোটবেলায় যে কথা বলে বলে বড় করেছি, আজ সেই কথাটা আবার স্মরণ করিয়ে দেই। তোমার যা করতে ইচ্ছে করবে, সেটাই তুমি করবে। শুধু খেয়াল রাখবে কাউকে যেন তুমি বিরক্ত করে না ফেল। আর আশপাশের সব মানুষজনকে সবসময় ভালোবাসবে। তাহলে তারা তোমাকে ঘৃণা করবে না। তবে মিশবে কেবল তাদের সঙ্গেই, যারা বুঝতে পারবে তুমি কেমন, যারা তোমাকে চিনতে পারবে; তোমাকে তোমার অপূর্ণতার জন্য অবহেলা করবে না।


আমি বুঝতে পারছিলাম, কথা বলতে মায়ের খুব কষ্ট হচ্ছে। এরপরও তিনি কথাগুলো বলে শেষ করলেন। আমি বললাম, মা, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমি আমার আশপাশের সকল মানুষকে ভালবাসবো, আর কেবল তাদের সঙ্গেই চলাফেরা করবো, যারা আমাকে বুঝতে পারবে।


মায়ের শরীর খুব খারাপ করেছে। এখন একটু ভালো আছে। জানি না, ক্যান্সারে আক্রান্ত আমার মা আর কতদিন ভালো থাকবেন। অক্ষরজ্ঞানহীন আমার মা, আমাদের ছয় ভাইবোনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা করিয়েছেন। দেশ-বিদেশ থেকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নিয়েছি। আমার জীবনের যা কিছু অর্জন তার কিছুই হয়তো আমি করতে পারতাম না, যদি না মা আমাকে নিয়ে প্রথম দিন থেকে পরিবার আর সমাজের সঙ্গে যুদ্ধ না করতেন। তিনি হাল ছেড়ে দেননি বলেই আমি আজ এতদূর পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছি।


মা কখনো আমার কোনো কাজে বাধা দেননি, কোনো কিছুতে ‘না’ করেননি, অপূর্ণতা নিয়ে জন্মেছি, কোনো দিন সেটা বুঝতে দেননি; সব সময় বলতেন, তুমি অবশ্যই অন্য আর সবার মতো সব কিছু পারবে।


আমার এই মা জীবনের সকল যুদ্ধে জয়ী হলেও ক্যান্সার নামক যুদ্ধের সঙ্গে আর পেরে উঠছেন না। খুব বলতে ইচ্ছে করছিলো, মা, সব কিছু এখানেই আছে, কেবল তুমি ছাড়া মনে হবে কিছুই নেই আমার ।


আহা, বাবা-মায়েরা যদি আজীবন বেঁচে থাকতো।


আমিনুল ইসলামের ফেসবুক থেকে


বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com