শিরোনাম
অসহ্য সুন্দর : আমেরিকার দিবস-রজনী
প্রকাশ : ২৩ এপ্রিল ২০১৭, ১৭:১১
অসহ্য সুন্দর : আমেরিকার দিবস-রজনী
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

সাংসারিক কিছু দৈনন্দিন কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করতে পারলেই এখানকার জীবন নিঃসন্দেহে অতি সুন্দর, অতি চমৎকার এবং অতি লোভনীয়। কিন্তু আমার মতন ষোলআনা খাঁটি বাঙালি একজন মানুষ, যে কিনা নির্লজ্জের মতো প্রতি পদে পদে নিজের মাটির সাথে পৃথিবীর অন্যসব মাটির তুলনা করতে একবিন্দুও দ্বিধা করে না, তার কাছে এখানকার সুন্দর জীবন মোটেও লোভনীয় নয়। বেশি সুন্দর যেমন মানুষের মনকে বিষাদ ও অতৃপ্তিতে ছেয়ে দেয়, এখানকার ''অতিরিক্ত সুন্দর'' জীবনও আমার কাছে তেমন মনে হচ্ছে। এখানকার মানুষ বড় বেশি শান্ত, বড় বেশি সভ্য। এতো শান্তি ও সভ্যতা তৃতীয় বিশ্বের একজন হাউকাউ করা অতি সাধারণ মানুষের পক্ষে আদতেই মেনে নেয়া দুষ্কর। আমিও বোধকরি তাই এখানকার সুন্দরতা হজম করতে পারছি না।


খুব ভালো করেই জানি, গতি ও ব্যস্ততার নামই জীবন এবং বেঁচে থাকা। তবুও এখানকার অতি গতি আর অতি ব্যস্ততা মনকে বিভ্রান্ত করে তোলে। এখানে আকাশ বড্ড বেশি পরিষ্কার, বাতাস বড্ড বেশি বিশুদ্ধ। এখানে বুকভরে নিঃশ্বাস নিলে বুকের ভেতরে কেমন হিম হিম একরকম অনুভূতি হয়। এই হিম ঠাণ্ডা অনুভূতি মনে করিয়ে দেয় এখানকার বাতাসের বিশুদ্ধতা। কিন্তু এতো যে বিশুদ্ধ অক্সিজেনে ভরা বাতাস। এখানে তবুও আমি নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে আমার প্রিয় শহরের বিষাক্ত সীসাযুক্ত গলা টিপে ধরা দম আটকে যাওয়া বাতাসকে খুঁজে বেড়াই।


সারাদিন বারবার করে ঘরের লাইটগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবি, ইশ যদি একবার ইলেক্ট্রিসিটি চলে যেতো! কিন্তু নাহ্, আমার ভাবনাকে তুড়ি মেড়ে উড়িয়ে দিয়েই মনে হয়, এখানে ইলেক্ট্রিসিটি চলে যাবার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনা। একবারও কলের পানি যায় না এখানে। প্রতিটি বাড়িতে রান্নাঘর থেকে বাথরুম - সব জায়গার কলেই গরম-ঠাণ্ডা পানির ব্যবস্থা। প্রতিটি বাড়িই সেন্ট্রালি এয়ারকন্ডিশন্ড এবং প্রতিটি বাড়িতেই ওয়াইফাই সুবিধা। রাস্তায় যাবার সময় মিনিটে মিনিটে বিভিন্ন দোকানপাট থেকে ফ্রি এবং ওপেন ওয়াইফাইর সিগনাল ফোনে কানেক্ট হয়ে যায়।


তবে প্রতিটি বাড়ির ওয়াইফাইই নিরাপত্তার স্বার্থে গোপন পাসওয়ার্ড দিয়ে সিকিওরড করা। বেশিরভাগ বাড়িতেই ইলেক্ট্রিক চুলায় রান্নার ব্যবস্থা। কিছু কিছু এলাকায় এবং কিছু কিছু বাড়িতে অবশ্য লাইনের গ্যাস দিয়েও চুলা জ্বলে। তবে কোথাও কোনো অনিয়ম নেই। কখনো গ্যাস বা ইলেক্ট্রিসিটির অপ্রতুলতার জন্য এখানে রান্নাবান্না বন্ধ করে রাখতে হয় না। রাত ৮টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত এখানে ইলেক্ট্রিসিটি ফ্রি।


এতো সুখের জীবন এখানে, তবুও বারবার মনে পড়ে গায়ে-মাথায় সাবান-শ্যাম্পুর ফেনা নিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কলের পানি চলে যাওয়ায় অসহায়ের মতন বাথরুমে দাঁড়িয়ে থাকা আমার নিজের ঘরের কথা কিংবা একঘর মেহমান টেবিলে খেতে বসেছে অমনি ইলেক্ট্রিসিটি চলে যাবার কথা মনে পড়ে মন অস্থির অস্থির করে ওঠে অথবা চুলায় ভাত রান্না চড়েছে আর হঠাৎ খেয়াল করলাম আস্তে আস্তে চুলার গ্যাস কেমন কমে গিয়ে টিমটিম কুপির মতন হয়ে একসময় দপ্ করে নিভে যাবার কথা মনে হয়ে প্রাণ কেমন করে ওঠে আমার।


এখানকার ডাউনটাউন (আমাদের মতিঝিল কমার্শিয়াল এরিয়ার মতন) ছাড়া বাকি কোনো বাড়ি হাইরাইজ নয় এবং কোনো ঘরবাড়িতে আমাদের মতন সমান ছাদ নেই। ডাউনটাউনের উঁচু উঁচু দালানকোঠা ছাড়া অন্যসব একতলা, দোতলা অথবা তিনতলা বাড়িঘর টালির ছাদ দেয়া একদম ইউরোপের মতন। ছবির মতন সাজানো-গোছানো এই দেশ। যেমন প্রকৃতি উদার হয়ে দুই হাতে তার সৌন্দর্য দান করেছে তেমনি এখানকার মানুষজন নিজেদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এই দেশকে সাজিয়েছে। চোখজুড়ানো দারুণ সুন্দর দেখতে এখানকার বাড়িঘর, দোকানপাট, অফিস, মার্কেট সবকিছু। এখানে সাধারণত তিনতলার বেশি উঁচু আবাসিক ঘরবাড়ি তৈরি হয় না।


আমাদের বিল্ডিং কমপ্লেক্সের ভেতরে অনেকগুলো বাড়িঘর, কিন্তু আশেপাশে নিঝুম নীরবতা। একবারের জন্যেও মনে হয় না যে এই কমপ্লেক্সে নানান দেশের এতো অসংখ্য লোকের বাস।


এখানকার ঘরবাড়ি প্রায় সবই কাঠের তৈরি, তাও আবার আমার দেশের লোহার মতন শক্তপোক্ত ভারি ভারি কাঠ নয়, একদম শোলার মতন হালকা-পাতলা কাঠ, যার এপাশে আঙুল দিয়ে আস্তে করে টোকা দিলেই ওপাশ থেকে একদম স্পষ্ট শোনা যায়।


আমাদের পাশের চারটা এ্যাপার্টমেন্ট একদম গায়ে গায়ে লাগানো, যেখানে একঘর ভারতীয় পরিবারও বাস করে, তবুও আমি এই ক'দিনে একটিবারের জন্যেও সেখান থেকে কোনো মানুষের শব্দ পাইনি। আপার্টমেন্টের এসি চলার শব্দে আর সন্ধ্যার পরে ঘরে ঘরে আলো জ্বলতে দেখলেই কেবল বোঝা যায় যে এখানেও লোকজন বাস করে।


নিচে পার্কিং লটে অসংখ্য গাড়ি নিঃশব্দে এসে পার্ক করে, নিঃশব্দেই গাড়ির মালিক ঘরে চলে যায়। আমি সকাল-বিকাল দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাঁটাচলা করা। কথা বলতে থাকা মানুষ খুঁজি, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই আমাকে আশাহত হতে হয়। মাঝেমধ্যে কাউকে দেখা যায় ঘরের জমানো আবর্জনা পলিথিনে নিয়ে ট্র্যাশ করতে বেরিয়েছে। আর কুকুর-বেড়ালকে মলত্যাগ করাতে বের হওয়া মানুষগুলিও কেবলমাত্র নিজেদের পোষা কুকুর-বেড়ালের সাথে ''কথা বলা'' ছাড়া একদম নির্বাক থাকে। একদিন অবশ্য সামনের লনে এক মেয়েকে দেখেছি কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলতে বলতে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আরেকদিন দেখলাম দুই বয়স্ক মহিলা নিজেদের গাড়ি স্টার্ট করার আগে যার যার গাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। কিন্তু সবই হচ্ছে প্রায় নিঃশব্দে। এতো নিঃশব্দে মানুষ কিভাবে যে চলাফেরা করে!


মাগরিবের নামাজ পড়ে আমি আর বেয়াইন সামনের লনে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। আধঘণ্টা মতন হেঁটে আমার হাঁপ ধরে যাওয়ায় আমি এক লেনের ওপর বসে বসে রাতের আমেরিকা দেখি আর বেয়াইন আমার সামনের লেনে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। কালো ফ্রক পরা এক চাইনিজ মেয়ে পাশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের গাড়ি লক করে গেলো।


চারিদিক থেকে অগুন্তি এসি চলার শব্দ ছাড়া বাদবাকি দুনিয়াদারি একদম পিনপতন নীরবতায় ছেয়ে আছে। আকাশভরা তারার মেলা। মাতাল করে দেয়া হিম হিম বসন্তের ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে। লিলি আর গোলাপের ঘ্রাণ বাতাসে ভাসছে। এখানকার রাতের এই অসহ্য সুন্দরতায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলা কোনো অলীক কল্পনা নয়, কিন্তু তবুও আমার কিচ্ছুই ভালো লাগছে না। আমার কেবল বৈশাখী গরমে হাঁশফাঁশ করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠা প্রিয় ঢাকার নাগরিক জীবনের কথা মনে পড়ে।


কি করবো আমি! আমি যে ক্ষণেক্ষণে আমার দেশটাকে মিস করি!


নীপা লায়লার ফেসবুক থেকে...


বিবার্তা/হুমায়ুন/যুথি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com