শিরোনাম
শহীদ শামসুজ্জোহাকে কান্নাভেজা স্যালুট
প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৩:০৬
শহীদ শামসুজ্জোহাকে কান্নাভেজা স্যালুট
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

আমি বলছি গুলিবর্ষণ হবে না। আর যদি গুলি করা হয় তবে কোনো ছাত্রের গায়ে লাগার আগে তা আমার গায়ে লাগবে। কথাগুলো ব‌লেই তি‌নি চুপ থা‌কেন‌নি, স‌ত্যি স‌ত্যিযখন উর্দি পরা লোকজন গু‌লি চালা‌লো তখন তি‌নি বুক পে‌তে দি‌লেন।


ভাব‌তেই আমার গা শিউ‌রে ওঠে। বল‌ছি শহীদ শামসুজ্জ‌োহার কথা। ৪৮ বছর আগে আজকের এই দিনে তিনি জীবন দিয়েছিলেন। আজ‌কের যুগ‌ে আপনারা যারা বিশ্ব‌বিদ্যাল‌য়ের শিক্ষক হ‌য়ে প্রশাস‌নের তেলবা‌জি করেন এবং ছাত্র‌দের কথা ভু‌লে যান তারা রাজশাহী বিশ্ব‌বিদ্যাল‌য়ের শিক্ষক শামসু‌জ্জোহার নাম‌টি স্মরণ ক‌রে নিজে‌দের বিবেক জাগ্রত কর‌তে পা‌রেন।


পু‌রো নাম তার মুহম্মদ শামসু‌জ্জোহা। জাতীয় জ্ঞান‌কোষ বাংলা‌পি‌ডিয়ার তথ্য বল‌ছে, ১৯৩৪ সালে জন্ম নেন তি‌নি। ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫০ সালে উচ্চ মাধ্য‌মিক পাস ক‌রে ভ‌র্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভা‌গে। ১৯৫৩ সালে তি‌নি রসায়‌নে বি.এসসি (সম্মান) এবং ১৯৫৪ সালে এম.এসসি ডিগ্রি লাভ করেন।


লেখাপড়া শেষ ক‌রে ১৯৬১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন শামসুজ্জ‌োহা। ওই বছরই তি‌নি আবার শিক্ষক প‌দে আবেদন ক‌রে রসায়ন বিভাগের লেকচারার পদে যোগ দেন। এরপর ১৯৬৪ সা‌লে তি‌নি লন্ডন থে‌কে পিএইচ‌ডি ক‌রেন। শাহ মাখদুম হ‌লের আবা‌সিক শিক্ষক থে‌কে ১৯৬৬ সালে তি‌নি প্র‌ভোস্ট পদে নি‌য়োগ পান। ১৯৬৮ সালের ১ মে তা‌কে বিশ্ব‌বিদ্যাল‌য়ের প্রক্টর করা হয়।


শামসু‌জ্জোহা ছি‌লেন মুক্তিকামী মানুষ। ১৯৫২ সা‌লে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালের শেষ দিক থেকে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন দানা বাঁধে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬৯ সা‌লের ২০ জানুয়ারি পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় ছাত্রনেতা আসাদকে হত্যা করে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে হত্যা করা হয় তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হকক‌ে। এসব ঘটনায় সারা বাংলাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। বাদ থাকেনি রাজশাহীও।


ছাত্র‌নেতা আসাদ ও সা‌র্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার বিরুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৭ ফেব্রুয়ারি ওই বিক্ষোভে পুলিশ হামলা চালা‌লে বহু ছাত্র আহত হয়। প্র‌তিবা‌দে পরদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে বিক্ষোভ শুরু করে। স্থানীয় প্রশাসন এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন নাটোর-রাজশাহী মহাসড়কে ১৪৪ ধারা জারি করে। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা সামরিক বাঁধা উপেক্ষা করে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়।


খবর পে‌য়ে ড. জোহা ছু‌টে যান সেখা‌নে। কারণ তি‌নি যে শুধু শিক্ষকই নন, ছাত্ররা যে তার সন্তান। তিনি ঘটনাস্থলে গি‌য়ে ছাত্র‌দের বোঝান। এরপর সেখানকার সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেন এবং ছাত্র‌দের উপর গুলি না চালানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু তার সেই অনুরোধ উপেক্ষা করে সেনাবাহিনী মিছিলের উপর গুলিবর্ষণ করলে ড. জোহা বুক পেতে দেন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে সমাহিত করা হয়।


গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে ড. জোহা তার ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আমি ‌তোমা‌দের বলছি গুলিবর্ষণ হবে না। আর যদি গুলি করা হয় তবে কোনো ছাত্রের গায়ে লাগার আগে আমার গায়ে লাগবে।


ড. জোহা তার কথা রেখেছিলেন। তার মৃত্যু আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। তার মৃত্যুতে সমগ্র দেশে বিক্ষোভের জোয়ার প্রবাহিত হয়। আইয়ুব সরকারের মসনদ কেঁ‌পে উঠে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেশের জন্য শামসুজ্জোহার সর্বোচ্চ ত্যাগের সম্মানে তার নামানুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নামকরণ করেন জোহা হল।


শামসুজ্জোহা ছিলেন ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯-এর ভেতরে শহীদ হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষক। নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে তিনি তার ছাত্রদের রক্ষার চেষ্টা করেছেন। আজকে যারা শিক্ষক হয়ে ছাত্রদের কথা ভুলে যান, নিজের মেরুদণ্ড বিকিয়ে দেন। প্রতিদিন সকাল বিকেলে তারা ছাত্র‌দের জন্য শামসুজ্জোহার জীবনদানের কথা স্মরণ কর‌তে পারেন। আমার মনে হয় শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যিলয় নয়, দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শামসুজ্জোহা দিবস পালন করা উচিত।


লেখাটা লিখ‌তে লিখ‌তে আমি কাঁদ‌ছি। আজকের এই দিনে শহীদ শামসুজ্জোহাকে কান্নাভেজা স্যালুট। আপপ‌নি বেঁচে থাক‌বেন বাংলা‌দে‌শের হৃদ‌য়ে। আপ‌রি আজীবন কো‌টি ছাত্র‌র স্যার হ‌য়ে থাক‌বেন। আমি দে‌শের প্রধানমন্ত্রী হ‌লে আজ‌কের দিনটা জোহা দিবস কিংবা শিক্ষক দিবস হিসেবে পা‌লন করতাম। সেটা আজ পার‌ছি না। তাই শুধু স্যালুট স্যার।


শরীফুল হাসানের ফেসবুক থেকে


বিবার্তা/যুথি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com