শিরোনাম
আমার সাংবাদিক জীবনের ইতিকথা
প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৯:১০
আমার সাংবাদিক জীবনের ইতিকথা
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

আমার সাংবাদিক জীবন শুরুর আগে জীবিকানির্বাহের জন্য আমি রকমারি কাজ করেছি।


বুকে কবি হওয়ার উন্মাদ বাসনা ও মাথায় হুলিয়া নিয়ে ১৯৬৬ সালে আমি স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসি। নাট্যকার মামুনুর রশীদ আমাকে কণ্ঠস্বর পত্রিকার সম্পাদক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সায়ীদ ভাই আমাকে কণ্ঠস্বর পত্রিকার ছুটা কাজে নিয়োগ দান করেন। কাজের মধ্যে ছিল কণ্ঠস্বরের জন্য ২৫% কমিশনে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করা, মাঝে মাঝে বিভিন্ন পত্রিকার স্টলে নতুন কণ্ঠস্বর পত্রিকা পৌঁছে দেয়া এবং বিক্রি না হওয়া পুরনো কণ্ঠস্বরগুলো ফেরত নিয়ে আসা, মাঝে মধ্যে লেখার প্রুফ দেখা (এই কাজে সিদ্ধহস্ত ছিল কবি সাযযাদ কাদির), আর সাদা কাগজে দুষ্প্রাপ্য পুরনো কাব্যগ্রন্থের প্রেসকপি তৈরি করা।


আমার হাতের লেখা সুন্দর ছিল বলে সাযযাদই ওই কাজটা আমাকে জুটিয়ে দিয়েছিল। প্রতি পৃষ্ঠা কপি করার জন্য, ঠিক মনে নেই, সম্ভবত চার আনা পারিশ্রমিক পেতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপকরা ওইসব গ্রন্থ সম্পাদনা করতেন। বাংলাবাজারের মাওলা ব্রাদার্স, নওরোজ কিতাবিস্তান ও স্টুডেন্ট ওয়েজ থেকে সেইসব বই প্রকাশিত হতো।


এভাবেই বাংলাবাজারের প্রকাশকদের সঙ্গে আমার মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে আমি তাদের প্রকাশিতব্য বইয়ের প্রুফ দেখার কাজ পাই। যত বেশি প্রুফ তত বেশি টাকা। আমি সারাদিন প্রুফ দেখে দশ-বারো টাকা পেতে শুরু করি। পাকিস্তান বুক কর্পোরেশনের পাঠ্যপুস্তক ও নোট বইয়ের প্রুফ দেখার ক্ষেত্রে আমি বিশেষ পারদর্শী ছিলাম। এখন নিজের বইয়ের প্রুফও আমি পারতপক্ষে দেখি না, দেখতে বিরক্ত বোধ করি। আর তখন অন্যের লেখার প্রুফ দেখাটাকেও গৌরবের বিষয় বলে মনে ভেবেছি।


কণ্ঠস্বর-এ মাস তিন চার কাজ করেছিলাম। এক পর্যায়ে কণ্ঠস্বরের প্রতি সংখ্যায় আবদুল মান্নান সৈয়দের রচনা প্রকাশের যৌক্তিকতা নিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে আমার মতবিরোধ হলে আমি ঢাকায় এসে পাওয়া প্রথম চাকরিটা ছেড়ে দিই।


বাংলাবাজারে একজন প্রুফদেখক হিসেবে পরিচিতি লাভ করি। তাতে আমার দৈনিক আয়ও বৃদ্ধি পায়। পত্রপত্রিকায় লেখার পরিমাণও বাড়ে। সেখান থেকেও কিছু পাই। কণ্ঠস্বর ছাড়ার পর, আরো দুটো মাসিক সাহিত্য পত্রিকায় কাজ পাই। প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ডের মুখপত্র মাসিক পরিক্রমে প্রুফ দেখা ও বিখ্যাত লেখকদের কাছ থেকে লেখা সংগ্রহ করতাম। আবুল হাসানও পরিক্রম পত্রিকায় আমার সহকর্মী হয়। কবি হাসান হাফিজুর রহমান আমাদের দুজনকে একই কাজে নিয়োগ দিয়েছিলেন। পরিক্রম পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশের সুযোগও মেলে। আমি হাসান আজিজুল হকের প্রথম গল্পবই ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছে’র সমালোচনা লিখেছিলাম।


দৈনিক আজাদ পত্রিকায় আমি কবিতা তো লিখতামই, ‘শুভেন্দু’ ছদ্মনামে একটি সাপ্তাহিক কলামও লিখতাম। কলামটির নাম ছিল ‘অটোগ্রাফ ফটোগ্রাফ’। কবিতার পাশাপাশি গদ্য রচনাতেও আমি হাত পাকাতে শুরু করি। জোনাকী নামক একটি মাসিক পত্রে আমি আরো একটি কলাম লিখতাম। ওই কলামটির নাম ছিল ‘ফসলবিলাসী হাওয়া’। বাংলাবাজার থেকে ওই পত্রিকাটি বেরুতো। সম্পাদকের নাম ছিল আবদুল মতিন। উনার দেশের বাড়ি ছিল ভৈরব। তখন আমরা ছিলাম বৃহত্তর ময়মনসিংহের মানুষ। সেই কারণে মতিন সাহেব আমাকে লেখার জন্য অন্যদের চেয়ে বেশি পারিশ্রমিক দিতেন।


বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত আমার ওই সময়ের লেখা গদ্যগুলোকে সাহিত্যপদবাচ্যই বলা চলে। কোনো দৈনিক পত্রিকায় সাংবাদিক হওয়ার জন্য আমার কবি-পরিচিতি বা আমার রচিত গদ্যগুলো কোনো কাজে আসছিল না। আজাদ, সংবাদ বা ইত্তেফাকে সাংবাদিক হিসেবে ঢোকার চেষ্টা করেও কোনো ফল হয়নি। আমার ক্রমবর্ধমান কবি পরিচয় আমার সাংবাদিক হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।


১২০ টাকা ফিস দিয়ে বিজ্ঞানী হওয়ার আশা ত্যাগ করে বাংলায় অনার্স নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। মাস কয়েক পর মনে হলো, এই বিনিয়োগটা ঠিক হয়নি। আবুল হাসানও আমার সঙ্গে একমত হলে পরে আমরা ড্রপ আউট করি।


১৯৬৯ সালে ‘দি পিপল’ নামে একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় শাহবাগ এলাকা থেকে। তৎকালীন হোটেল শাহবাগের-এর উল্টোদিকে, সাকুরার পেছনেই ওই পত্রিকার অফিস। সম্পাদক আবিদুর রহমান সাহেব নিজেও গান-কবিতা লেখেন। এই সংবাদ জানার পর আশায় বুক বেঁধে আমি তার সঙ্গে দেখা করি। তাকে আমার বেশ পছন্দ হয়। তিনিও আমাকে পছন্দ করেন। আমি ২৫০ টাকা মাসিক বেতনে দি পিপল পত্রিকায় সাব এডিটর হিসেবে যোগাদান করি।


করাচির ডন পত্রিকা থেকে ঢাকায় ফিরে আসা আবদুস সোবহান সাহেব পিপলের নিউজ এডিটর নিযুক্ত হন। আমার ইমিডিয়েট বস তিনি। তিনিও কবিতা ভালোবাসেন। আমার কবিতা তিনিও পছন্দ করেন। একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার সাব-এডিটর হিসেবে আমার সাংবাদিক জীবন শুরু হয়।


১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত ওই পত্রিকায় আমি কাজ করি। ২৫ মার্চের রাতে পাকসেনারা পিপল পত্রিকার অফিসে আক্রমণ করে। তারা গান পাউডার দিয়ে অফিসটি পুড়িয়ে দেয়। বেশ কজন প্রেস কর্মচারী ও পিয়ন ওই রাতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। আমার ভাগ্য ভালো, ওই রাতে আমি পিপলে ছিলাম না। আমার বন্ধু নজরুল ইসলাম শাহ আমাকে অফিসে যাওয়া থেকে সেই রাতে বিরত করেছিলেন।


ভোরের কাগজ পত্রিকার ২৫ বছর পূর্তিতে প্রকাশিতব্য বিশেষ সংখ্যার জন্য সম্পাদক শ্যামল দত্তর বিশেষ অনুরোধে একটি ছোট্ট লেখা দিতে রাজি হয়েছিলাম। লিখতে বসে দেখছি লেখাটি বড় হয়ে যাচ্ছে। গিলিপিনের পাগলা ঘোড়াটিকে কিছুতেই থামাতে পারছি না। আপাতত ভোরের কাগজের সমৃদ্ধি কামনা করে এখানেই লেখাটির ইতি টানছি।


মনে পড়ছে ২৫ বছর আগে ভোরের কাগজের উদ্বোধনী সংখ্যায় লিখেছিলাম। সংবাদপত্রে আর কখনো না লেখার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে, এই লেখাটি লিখলাম। লিখলাম এই জন্য যে, মতিউর রহমান এই পত্রিকা ছেড়ে ‘প্রথম আলো’য় যোগদান করার সময় আমি এই পত্রিকাটির সম্পাদক হতে চেয়েছিলাম। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বন্ধু বেনজির আহমদকে বলেছিলাম আমার সেই ইচ্ছের কথা। মতিউর রহমানকেও বলেছিলাম আমার এই অভিপ্রায় ভোরের কাগজের মালিকপক্ষকে অবহিত করার জন্য। না মতিউর রহমান, না বেনজির - কেউই বিষয়টি মালিকপক্ষের গোচরে আনেননি বলেই আমার ধারণা।


শ্যামল কিছু মনে করো না, এই পত্রিকার সম্পাদক আমিও হতে পারতাম। কবি শামসুর রাহমান বা আল মাহমুদের চেয়ে একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক হওয়ার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা আমারই বেশি ছিল।


নির্মলেন্দু গুণের ফেসবুক থেকে


বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com