শিরোনাম
আইন ভেঙ্গে ১৯০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ক্রয়
প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ২০:১৯
আইন ভেঙ্গে ১৯০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ক্রয়
মৌসুমী ইসলাম
প্রিন্ট অ-অ+

সঞ্চয়পত্র বিক্রির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে তা কিনে নিয়েছে আট ব্যাংক। আইনের তোয়াক্কা না করে কেনার দৌঁড়ে রয়েছে আরও আট প্রতিষ্ঠান। এভাবে মোট ১৬ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অতিমুনাফার লোভে কিনেছে প্রায় ১৯০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। এরই মধ্যে ১০টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে তুলে নিয়েছে ১০০ কোটি টাকা।


ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার বেশি, তাই এই মাধ্যমকে বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে দেরিতে হলেও এমন অনিয়মের সন্ধান পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সার্বিক দিক অনুসন্ধান করতে জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের মহাপরিচালককে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সরকার। স্বল্প সময়ের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে কমিটিকে।


আয়কর বিধিমালায় স্পষ্ট বলা আছে, সকল শ্রেণী-পেশার বাংলাদেশ নাগরিক সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবেন। এছাড়া মৎস্যখামার, হাঁস-মুরগীর খামার, পোল্ট্রি ফিডস উৎপাদন, বীজ উৎপাদন, স্থানীয় উৎপাদিত বীজ বিপণনসহ ১৩টি খাত থেকে অর্জিত আয় দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে। তবে এই আইনের তোয়াক্কা না করেই বড় অংকের অর্থ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ হয়।


অনুসন্ধানে দেখা যায়, সব ব্যাংকের কাজ হলো সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা, কিন্তু বিক্রির দায়িত্ব পেয়ে তারা উল্টো কিনে নিয়েছে সঞ্চয়পত্র। যেমন, ইষ্টার্ন ব্যাংক ১৮ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র কিনে রেখেছে, যার মুনাফার হার দাঁড়িয়েছে ৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ১৪ কোটি ৬০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনেছে আইএফআইসি ব্যাংক। তাদের মুনাফা হয়েছে ৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। পূবালী ব্যাংকের বিনিয়োগ ৮ কোটি টাকা। যার মুনাফার হার ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে সিটি ব্যাংক এনএ। তাদের মুনাফা হয়েছে ২০ লাখ টাকা। ব্যাংক এশিয়ার বিনিয়োগের পরিমাণ ২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। আর মুনাফা হয়েছে ১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এইচএসবিসি ব্যাংক কিনেছে ২৫ কোটি ৯০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। তাদের মুনাফা হয়েছে১৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। আর এবি ব্যাংকের বিনিয়োগের পরিমাণ ২ কোটি টাকা, যার মুনাফার অংক হচ্ছে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা।


সঞ্চয়পত্র কেনার দৌঁড়ে পিছিয়ে নেই বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও। ৫০ কোটি ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনেছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। যার মুনাফা দাঁড়িয়েছে ২৫ কোটি ৫৮ লাখ। একই কর্ম করেছে লিভার ব্রাদার্স বাংলাদেশ লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানটি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে ৩৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর এতে মুনাফা দাঁড়িয়েছে ১৫ কোট ৬ লাখ টাকা। বার্জার পেইন্ট কিনেছে ১১ কোটি ৪৩ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। তাদের মুনাফা হয়েছে ১৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা। একইভাবে পিপলস সিরামিক কিনেছে ৪ কোটি ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, যার মুনাফার হার এখন ৬০ লাখ টাকা। বণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হয়েও স্ট্যান্ডার্ড সিরামিক কিনেছে ১ কোটি ৯০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। মুনাফার হার দাঁড়িয়েছে ৩৩ লাখ টাকা। এনজিও আশা’র নামও আছে সঞ্চয়পত্র ক্রেতার তালিকায়। এই প্রতিষ্ঠানটি কিনেছে ৪ কোটি ২৭ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। যার মুনাফার হার দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। বিএটিবি কোম্পানি লিমিটেড কিনেছে ৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। মুনাফা হচ্ছে ৩০ লাখ টাকা। নোকিয়া ইএ কিনেছে ১৯ লাখ ২০ হাজার টাকার সঞ্চয়পত্র। যার মুনাফা এখন দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৫২ হাজার টাকা। এছাড়া ব্রিটিশ অ্যামেরিকান ট্যোবাকো কিনেছে ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, যার মুনাফা হয়েছে ১৮ লাখ টাকা।


সব মিলিয়ে মোট ১৬টি প্রতিষ্ঠান কিনেছে ১৯০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। তাদের মোট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৮৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।


১৬ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০টি ব্যাংক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আসল তুলে নিয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। তবে তাদের সঞ্চয়ের ৪৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।


তদন্ত কমিটির প্রধান জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা বিবার্তাকে জানান, অজ্ঞতার কারণে হোক বা জেনেশুনে হোক, প্রাতিষ্ঠানিক কিছু বিনিয়োগ এই সঞ্চয়পত্রে করা হয়েছে, যেটি বিধিসম্মত হয়েছে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না। বিনিয়োগকারীদের দাবি, যাতে লভ্যাংশসহ এই অর্থ পায়। হয়তো তাদের বিবেচনায় তাদের দাবি যৌক্তিক, আবার সরকারকেও আইনের বিষয়টি মাথায় রেখে এগিয়ে যেতে হয়।


তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীরা এনবিআরের কিছু তথ্য তুলে ধরেছে। কিন্তু এনবিআরের তথ্য যেটা আছে, হয়তো তার ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।


এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বিবার্তাকে বলেন, এটা আইনের পরিপন্থী হলে করা ঠিকই হয়নি, বরং তাদের লভ্যাংশ ফেরত দিতে হবে। কারণ, এটা আইনবহির্ভূত। এজন্য সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে। সঞ্চয়পত্র নিম্ন আয়ের বা নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের বিনিয়োগের জায়গা। এটার একটা সীমারেখা আছে যে, কারা কারা বিনিয়োগ করতে পারবে। সঞ্চয়পত্রের যে অপব্যবহার হচ্ছে এটা তার একটা উদাহরণ। এজন্য সুদহার কমানো হচ্ছে। কিন্তু এটা ঠিক না। সরকারের এ ব্যাপারগুলো লক্ষ্য রাখতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রয়োজনে টাকা ফেরত নিতে হবে। শুধু এসব প্রতিষ্ঠান না, অনেক ধনী ব্যক্তিও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে। এসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নীতিমালা সুস্পষ্ট করতে হবে।


তবে এ বিষয়ে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হালিম চৌধুরী বললেন ভিন্ন কথা। তিনি বিবার্তাকে বলেন, সঞ্চয়পত্র কিনে রাখার কিছু নিয়ম আছে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী কিছু ফান্ডে এটা বিনিয়োগ করা যায়। আমাদের যেটা অনুমতি আছে, সেটাই মাঝে মাঝে কেনা হয়। আইন অনুযায়ী ব্যাংক এসব সঞ্চয়পত্র কিনে রেখেছে। এর বাইরে কিছু নয়।


বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com