‘আমি শিল্পী নই। নাট্যকার বা অন্য যেকোনো আখ্যা লোকে আমাকে দিতে পারে। তবে আমি মনে করি আমি প্রপাগান্ডিস্ট। এটাই আমার মূল পরিচয়`। নিজের সম্পর্কে এভাবেই বলেছিলেন উৎপল দত্ত। হীরক রাজা খ্যাত এই অভিনেতা বিখ্যাত বাঙালি নাট্য নির্দেশক, অভিনেতা, নাট্যকার, নাট্যতজ্ঞ ও সম্পাদক। তিনি এ উপমহাদেশের শিল্পাঙ্গনে এক বিরাট বিস্ময়! যেমন ছিলেন মঞ্চে, তেমনি ক্যামেরার সামনে; ঠিক তেমনি নিজেকে অমর করে রেখেছেন নাট্যকার হিসেবে।
১৯ আগস্ট এই কিংবদন্তির ২৪তম প্রয়াণ দিবস। বাংলার এই মহান নাট্যকার ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের আজকের দিনে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। এদিনে তাকে বিনম্র শদ্ধায় স্মরণ করছে দুই বাংলার সংস্কৃতাঙ্গন।
আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের ইতিহাসে অভিনেতা, নাট্যনির্দেশক ও নাট্যকার হিসেবে তার স্থান সুনির্দিষ্ট। উৎপল দত্ত প্রথম দিকে বাংলা মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতেন। তাকে গ্রুপ থিয়েটার অঙ্গনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের অন্যতম হিসাবে গণ্য করা হয়। কৌতুক অভিনেতা হিসেবেও তার খ্যাতি রয়েছে। উৎপল দত্ত সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় হীরক রাজার দেশে ছবিতে হীরক রাজার চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি সত্যজিতের জয় বাবা ফেলুনাথ এবং আগন্তুক সিনেমায় অভিনয় করেছেন।
রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে তিনি ছিলেন বামপন্থী ও মার্কসবাদীয়। তার মানুষ সংক্রান্ত চেতনা শ্রেণিসমাজের বাস্তব চেতনাকেই ধারণ করে। সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদি মানুষ সম্পর্কে তার গভীরতম ধারনা তার নাটকগুলোকে সফল করেছে। বঙ্গীয় রেনেসাঁসের এক বিশ্লেষকও তিনি। উনিশ শতকের বঙ্গীয় সামন্ত শ্রেণির বিরুদ্ধে মধুসূদনের বিদ্রোহকে তিনি মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, মধুসূদন শেষ পর্যন্ত উনিশ শতকের ঘুণধরা ও বিকলাঙ্গ সমাজের বিরুদ্ধে মূর্তিমান বিদ্রোহ।
উৎপল দত্ত ১৯২৯ সালের ২৯ মার্চ অবিভক্ত বাংলার বাংলাদেশের বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম গিরিজারঞ্জন দত্ত ও মাতা শৈলবালা দত্ত। পড়াশুনা শিলঙের অ্যাডমন্ডস স্কুল হয়ে কলকাতার সেন্ট লরেন্স, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ১৯৪৮ সালে ইংরেজি বিষয়ে কলেজের ছাত্রদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে বিএ পাস করেন। ১৯৪৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ইংরেজি অনার্সে তার স্থান ছিলো পঞ্চম। ছাত্র অবস্থা থেকেই শেক্সপিয়ারের নাটকের অভিনয় ও নাট্যচর্চার সূত্রপাত তার।
সৌখিন শেক্সপিয়ার দলে অনেক ইংরেজি নাটকেও অভিনয় করেন উৎপল দত্ত। তিনি প্রথম অভিনয় করেন উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট নাটকে গোরখনকের ভূমিকায়। তিনি শেক্সপিয়ার আন্তর্জাতিক থিয়েটার কোম্পানির সঙ্গে ভ্রমণ করেছেন বেশ কয়েকবার। জেফরি কেনডালের শেক্সপিয়ারানা সম্প্রদায়ের সঙ্গে ভারত পর্যটনে বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন রকমের দর্শক সমাবেশে ধ্রুপদী নাটক পরিবেশন করেন।
১৯৪৭ সালে লিটল থিয়েটার গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করে শেক্সপিয়ার, বার্নাড শ, ক্লিফর্ড ওডেটস প্রমুখের নাটক ইংরেজিতে প্রযোজনা করতে করতেই সীমিত দর্শক সমাজের সীমাবদ্ধতায় বিব্রত হয়ে লিটল থিয়েটার গ্রুপকে (এলটিজি) বাংলা প্রযোজনার দিকে পরিচালিত করেন। তার পরিচালিত এ গ্রুপের উল্লেখযোগ্য নাটক হলো ওথেলো, নিচের মহল, ম্যাকবেথ, গিরিশ ঘোষের সিরাজউদ্দৌলা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তপতী, অচলায়তন এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রহসন বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ ইত্যাদি।
উৎপল দত্ত পরে ১৯৭১ ‘পিএলটি’ অর্থাৎ ‘পিপলস লিটল থিয়েটার’নামে করেন আরেকটি নাট্যদল গঠন করেন। তার নির্দেশিত ও রচিত প্রায় প্রতিটি নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। উৎপল দত্তের অভিনয় ক্ষমতা ছিলো অনুকরণীয়। পিপলস লিটল থিয়েটারে ‘টিনের তলোয়ার’ নাটক তার একটি বড় পদক্ষেপ। তার রাজনৈতিক নাটকগুলোর মধ্যে পাওয়া যায় শ্রেণি চেতনা, ইতিহাস চেতনা ও মধ্যবিত্ত চেতনা।
এছাড়াও তার তার অভিনীত বিখ্যাত নাটকের মধ্যে রয়েছে মেঘ, রাইফেল, সীমান্ত, ঘুম নেই, মে দিবস, দ্বীপ, রাতের অতিথি, মধুচক্র, সমাজতান্ত্রিক চাল, সমাধান ইত্যাদি। নাটক, যাত্রাসহ বহু বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেও ব্যাপক খ্যাতির অধিকারী হন উৎপল দত্ত। তিনি বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রও পরিচালনা করেন। তার পরিচালিত ছবির মধ্যে মেঘ, ঘুম ভাঙার গান, ঝড়, বৈশাখী মেঘ, মা ইত্যাদি।
নাট্যবিষয়ক বহু প্রবন্ধ ও একাধিক গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। বাংলায় অনুবাদ করেছেন বেশকিছু বিদেশি ভাষার নাটক। তিনি দীর্ঘকাল ধরে এপিক থিয়েটার নামক একটি সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন এবং দেশ-বিদেশের নাট্যবিষয়ক বহু সভা-সেমিনারেও অংশগ্রহণ করেছেন।
নাট্যচর্চায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি দীনবন্ধু পুরস্কার, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার লাভ করেন। মজার বিষয় হচ্ছে এই মহান পুরুষ নানা অভিমানের জায়গা থেকে ভারত সরকারের দেয়া পদ্মভূষণ উপাধি ও সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।
বিবার্তা/অনামিকা
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]