শিরোনাম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছিলেন যারা
প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০১৮, ১১:৩০
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছিলেন যারা
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

ভারতবর্ষে উচ্চশিক্ষার শুরু ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর। ১৮৫৭ সালে ভারতের বড় লাট লর্ড ক্যানিং ‘দ্য অ্যাক্ট অফ ইনকরপোরেশন’ পাশ করে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।


বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হল কলকাতা, বোম্বে ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়। এর আগে থেকেই ভারতবর্ষে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল কিন্তু এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয় ইউরোপীয় মডেলে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরও মান ছিল উঁচু। আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছিলেন মূলত পশ্চিমবঙ্গের উঁচুতলার হিন্দু সন্তানরা।


১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আগে অবিভক্ত বাংলায় ১৯টি কলেজ ছিল। তার মধ্যে পূর্ব বাংলায় নয়টি। তবে সেটাই পর্যাপ্ত ছিল বলে মনে করেননি তখনকার পূর্ব বাংলার মানুষ।


১৯০৫ সালে বাংলা প্রেসিডেন্সি ভাগ করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন এক প্রদেশ করা হয়। পূর্ববঙ্গে পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠী বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে আসা ছিল বঙ্গভঙ্গের একটি অংশ।


বঙ্গভঙ্গের এই সময়টা ছিল খুব অল্প সময়ের জন্য, মাত্র ছয় বছর। কারণ এর মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু নেতারা প্রবল আন্দোলন করেন এই বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে।



এদিকে মুসলিম নেতারা নতুন প্রদেশ হওয়াতে শিক্ষাসহ নানা সুবিধা পাবেন এই আশায় উজ্জীবিত হন। কিন্তু গোটা ভারতবর্ষে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তাদের বিরোধিতার মুখে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। ফলে মুসলিমদের ক্ষোভ আরো পুঞ্জিভূত হতে থাকে। তারা মনে করে অর্থনৈতিক বৈষম্যের সাথে সাথে শিক্ষা ক্ষেত্রেও তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।


লেখক এবং গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ তার ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা বইয়ে লিখেছেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বাঙালী মুসলিমদের ক্ষোভ ছিল ১৯০৫’এ পূর্ব বাংলা এবং আসাম প্রদেশ গঠনের অনেক আগে থেকেই। ... ক্ষোভের কারণ শুধু হিন্দু প্রাধান্য নয়, শিক্ষাক্রমে হিন্দুধর্ম প্রাধান্য পাওয়ায় মুসলিমদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।


যারা বিরোধিতা করেছিলেন:


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বিরোধী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর নাম সৈয়দ আবুল মকসুদের ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা' বইতে উঠে এসেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোকজনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন বলে উল্লেখ করা হয়।


ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালে তার ঢাকা সফর শেষে কলকাতা প্রত্যাবর্তন করলে ১২ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল তার সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতামূলক একটি স্মারকলিপি পেশ করেন।


এ সংক্রান্ত বিভিন্ন বইতে উঠে এসেছে, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে লর্ড হার্ডিঞ্জ জানতে চেয়েছিলেন, কী মূল্যে অর্থাৎ কিসের বিনিময়ে তিনি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকবেন?


শেষ পর্যন্ত স্যার আশুতোষ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চারটি নতুন অধ্যাপক পদ সৃষ্টির বিনিময়ে তার বিরোধিতার অবসান করেছিলেন। পরবর্তীতে স্যার আশুতোষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষক নিয়োগে সহযোগিতা করেন। তার সঙ্গে ছিলেন স্যার নীলরতন সরকার।



কেন এই বিরোধিতা?:


কথা সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক কুলদা রায় তার ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা ও রবীন্দ্রনাথ' নামক প্রবন্ধে লিখেছেন মূলত-বিরোধিতা করেছিলেন তিন ধরনের লোকজন।


১. পশ্চিমবঙ্গের কিছু মুসলিম: তারা মনে করেছিলেন, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হলে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের কোনো লাভ নেই। পূর্ববঙ্গের মুসলিমদেরই লাভ হবে। তাদের জন্য ঢাকায় নয় পশ্চিমবঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়াটাই লাভজনক।


২. পূর্ব বাংলার কিছু মুসলিম: তারা মনে করেছিলেন, পূর্ববঙ্গের মুসলিমদের মধ্যে ১০ হাজার জনের মধ্যে একজন মাত্র স্কুল পর্যায়ে পাশ করতে পারে। কলেজ পর্যায়ে তাদের ছাত্র সংখ্যা খুবই কম। বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেখানে মুসলিম ছাত্রদের সংখ্যা খুবই কম হবে। পূর্ববঙ্গে প্রাথমিক ও হাইস্কুল হলে সেখানে পড়াশুনা করে মুসলিমদের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়বে এবং আগে সেটা দরকার। যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে মুসলিমদের জন্য যে সরকারি বাজেট বরাদ্দ আছে তা বিশ্ববিদ্যালয়েই ব্যয় হয়ে যাবে। নতুন করে প্রাথমিক বা হাইস্কুল হবে না। যেগুলো আছে সেগুলোও অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। সেজন্য তারা বিশ্ববিদ্যালয় চাননি।


৩. পশ্চিমবঙ্গের কিছু হিন্দু মনে করেছিলেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বরাদ্দ কমে যাবে। সুতরাং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চলবে কীভাবে? এই ভয়েই তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি বিরোধিতা করেছিলেন:


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা কী ছিল তা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। যারা বলেছেন তিনি এর বিরোধিতা করেছিলেন তারা স্বপক্ষে দালিলিক কোনো তথ্য-প্রমাণ দেননি।


সেই সময়কার সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা এবং রবীন্দ্রনাথের সেই সময় যাদের সঙ্গে উঠা-বসা ছিল তাদের কয়েকজন ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে। তাই অনেকেই সহজ সমীকরণ মিলিয়ে লিখেছেন তিনিও এর বিপক্ষেই ছিলেন।



যারা পক্ষে কাজ করেছিলেন:


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা যে হয়েছিল নানা পক্ষ থেকে সেটা ইতিহাস ঘাটলে তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আবশ্যকতা রয়েছে সেটা বোঝাতে ও প্রতিষ্ঠার ব্যাপার অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন যারা তাদের কথা না বললেই নয়।


এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। কিন্তু হঠাৎ করে ১৯১৫ সালে নবাব সলিমুল্লাহের মৃত্যু ঘটলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী শক্ত হাতে এই উদ্যোগের হাল ধরেন। অন্যদের মধ্যে আবুল কাশেম ফজলুল হক উল্লেখযোগ্য।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার হিন্দুরাও এগিয়ে এসেছিলেন। এদের মধ্যে ঢাকার বলিয়াদির জমিদার অন্যতম। জগন্নাথ হলের নামকরণ হয় তার পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে। সূত্র: বিবিসি বাংলা


বিবার্তা/জাকিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com