আমাদের দেশে আবহমান কাল ধরে দেশি কৈ মাছ (Anabas testudineus) একটি অভিজাত ও জনপ্রিয় মাছ হিসেবে পরিচিত। মাছটি খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। তবে বর্তমানে দেশী কৈ পাওয়া দুষ্কর। বাণ্যিজ্যিকভাবে পোনার সহজলভ্যতা ও দ্রুত বর্ধনশীল হওয়ায় থাই ও ভিয়েতনামি কৈ বাজার দখল করেছে।
বিভিন্ন কারণে বিশেষ করে উন্নত মা মাছের প্রতুলতা, পুকুরে চাষ ও পোনা উৎপাদনের কৌশল না জানা, পানি দূষণ, নদীর নাব্যতা না থাকা ও অতিরিক্ত মৎস্য আহরণের ফলে দিন দিন দেশি কৈ হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া, দেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচের জন্য বাঁধ নির্মাণ ও শিল্প কারখানার বর্জ্য ও কৃষিজ আবর্জনার জন্য অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে প্রাচুর্যতা কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি জলাশয়ে প্রাকৃতিক বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্র বিনষ্ট হওয়ায় ইতোমধ্যে মাছটি বাজার থেকে হারাতে বসেছে।
বিশ্ব পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থার (আইইউসিএন) মতে, মাছটি বিপন্নপ্রায় প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এ.কে. শাকুর আহম্মদ পুকুরে খাঁচায় নিবিড় গবেষণায় মা মাছ (ব্রুড ফিস) উৎপাদন ও কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে গুণগতমানের পোনা উৎপাদন ও খাচায় মাছ চাষের সফলতা লাভ করছেন। ফলে দেশী কৈ মাছের পোনা প্রাপ্তির পথ সুগম হয়েছে। এতে বিভিন্ন জলাশয়ে মাছের প্রাচুর্যতা ও জীব বৈচিত্র সংরক্ষিত হবে।
গবেষক শাকুর আহম্মদ বলেন, প্রজনন মৌসুমে এবং মেঘাচ্ছন্ন ও বৃষ্টির সময় দেশি কৈ মাছ পুকুর থেকে কানকোর সাহায্যে হামাগুরি দিয়ে অন্যত্র চলে যায়। এমনকি পুকুরের চারদিকে জাল দিয়ে বেড়া দিলেও সেখান থেকে চলে যায়। এই সমস্যা রোধকল্পে পুকুরে খাঁচা পদ্ধতির (Cage culture system) মাধ্যমে চাষ করে গুণগত মা মাছ উৎপাদনে সফলতা পেয়েছি। পরবর্তীতে সেখান থেকে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তির থামোস্ট্যাটের সাহায্যে ভ্রুণ অবস্থায় বিভিন্ন তাপমাত্রায় তাপ প্রয়োগ করে পোনা উৎপাদন করা হয়। সেখান থেকে অধিক ডিম ফোটার হারের উপর নির্ভর করে উন্নত গুণগতমানের পোনা বাছাই করা হয়।
বাছাইকৃত পোনাগুলোকে (Larvae) এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া, বিশেষ করে বেসিলাস ব্যাকটেরিয়া সাহায্যে নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অ্যাকুরিয়াম, জগ এবং পুকুরে হাপা সিস্টেমে চাষ করা হয়। এক্ষেত্রে মৃত্যুর হার অনেক কম এবং উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে।
কারণ হিসেবে বলা যায়, এই ব্যাকটেরিয়াগুলো পানিতে ছেড়ে দিলে পানির গুণাগুণ বজায় রাখে, পোনা মাছের Immune system বৃদ্ধি করে। এছাড়া মাছের অন্ত্রে গিয়ে তাদের খাবার পরিপাক ও শোষণের ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে তারা বেশি পরিমাণ খেতে পারে। ফলে তাদের বৃদ্ধি বেশি হয়।
গবেষক আরো জানান, খাঁচার মাধ্যমে দেশি মা কৈ মাছ উৎপাদন কৌশল এটিই প্রথম। এই পদ্ধতির মাধ্যমে দেশি কৈ মাছকে সংরক্ষণ ও বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। বাংলাদেশে আমিষের চাহিদা পুরণ এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশী কৈ মাছের পোনা উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই। তাই উচ্চগুণসম্পন্ন অধিকসংখ্যক দেশী কৈ মাছের পোনা উৎপাদন করে বাংলাদেশের উন্মুক্ত জলাশয়ে, বিশেষ করে হাওর এলাকায় ছাড়া (Ranching) গেলে সম্প্রতি হাওরে মাছের যে জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়েছে, তা অনেকটা লাঘব হবে এবং সেখানকার জেলেদের জীবিকার পথ সুগম হবে। বাণিজ্যিকভাবেও চাষ করা সম্ভব হবে।
বিবার্তা/শাহীন/নিশি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]