পরিবর্তন প্রকৃতি ও মানুষের একটা সহজাত ধর্ম। সময়ের প্রবাহমানতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দু'টোই বদলে যায়। সৃষ্টির অনাদিকাল থেকে এ নিয়ম চলে আসছে। পরিবর্তনের এ ধারাটা ছিল ধীর ; এমনকি বলতে গেলে প্রায় অদৃশ্যই। ফলে এ নিয়ে মানুষের মাথা ঘামানোর খুব বেশি কিছু ছিল না।
কিন্তু দিন বদলে গেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর প্রাগ্রসরতায় এখন পরিবর্তন ঘটছে যেন প্রায় প্রতিদিনই। একেকটা প্রযুক্তি আসছে আর চোখের পলকে তা বদলে দিচ্ছে মানুষের জীবনকে ; এমনকি খোদ মানুষটিকেও। সম্প্রতি ভারতে বিশ্ববিখ্যাত টেলি-কমিউনিকেশন সংস্থা মোটোরোলা এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মাইন্ড ব্রেন বিহেভিয়ার ও সায়েন্স অব হ্যাপিনেস’ যৌথভাবে যে সমীক্ষাটি চালিয়েছে, তারই ফল সেটাই যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো আমাদের।
সমীক্ষা বলেছে, ভারতের ৪৭% মানুষ এমনকি মা-বাবার চেয়েও বেশি ভালবাসে স্মার্টফোনকে। মা-বাবার সঙ্গে কথা না বলে একটি গোটা দিন কাটিয়ে ফেলতে পারলেও স্মার্টফোন ছাড়া ২৪ ঘণ্টা কাটানো তাদের পক্ষে অসম্ভব! কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর অজান্তেই তাদের হাত চলে যায় ফোনে। তারা স্মার্টফোনের ‘নেশা’ ছাড়তে পারছে না।
কী ভয়ানক কথা ! মানুষ নামের বুদ্ধিমান প্রাণীটি কি ক্রমশ নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে? সমীক্ষায় এরও জবাব খোঁজা হয়েছে। জানা গেছে, সত্যিই মানুষ ধীরে ধীরে স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছে এবং মোবাইল ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্ত হয়ে পড়ছে। বাস্তব জীবনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ক্রমশ কমছে এবং নেটজগতকেই তারা আপন করে নিচ্ছে।
এ যুগে মানুষ নতুন-নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করবে, নব নব প্রযুক্তিকে আপন করে নেবে, এটাই স্বাভাবিক ও কাম্য। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় মানুষ ও তাদের সমাজ বদলে যাবে, এতে অবাক হওয়ার হওয়ার কিংবা দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। নিরবচ্ছিন্ন পরিবর্তনপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তো বিশ্ব আজকের অবস্থানে এসেছে।
কিন্তু এ কেমন পরিবর্তন, যা মানুষকে সেই গুহাবাসী আদিম মানবের জীবনে ফিরিয়ে নিচ্ছে! আদিম মানুষের জীবনে সমাজ ছিল না, সংসার ছিল না। কয়েকটা জৈবিক চাহিদা পূরণ হলেই তাদের প্রয়োজন শেষ হয়ে যেত।
মানবজাতি সেই আদিম জীবন ছেড়ে আজ বহুদূর এগিয়ে এসেছে। এখন তাদের দেশ আছে, সমাজ আছে, সংসার আছে। মোটের ওপর একজন মানুষ আজ নিছক ব্যক্তিমাত্র নয়, বরং বৃহত্তর মানবসমাজেরই অংশ। মানবজাতি তিলে তিলে সভ্যতার এ মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে এবং তা মান্য করেও এসেছে। এখানে মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য যেমন স্বীকৃত, তেমনি সামাজিক দায়িত্ববোধের অদৃশ্য কিন্তু অবশ্যমান্য নির্দেশনাও আছে।
কিন্তু প্রযুক্তির প্রতি লাগামহীন আসক্তি মানুষকে যেন আপন সভ্যতার সেই চিরায়ত রীতিনীতি ভুলিয়ে দিতে চাচ্ছে আর তাকে করতে চাচ্ছে আদিম মানুষের মতোই নিঃসঙ্গ, একা, বিবরবাসী। পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব এড়িয়ে প্রযুক্তিকে নেশা বানিয়ে মানুষের তাতে নিমজ্জিত হওয়া - তা নিয়েই আমাদের যত ভয়। ভাবতেও ভয় হয়, মানুষ আজ চলেছে কোথায়?
আমরা প্রযুক্তিবিরোধী নই। প্রযুক্তি আসুক ; মানুষের প্রয়োজনে, সেবায় ও কল্যাণে। কিন্তু মানুষ যেন তার সত্তা ও শ্রেষ্ঠত্ব ভুলে প্রযুক্তির পদতলে নিজেকে সমর্পণ না-করে, যেন প্রযুক্তির আজ্ঞাবহ হয়ে না যায় - এটাই আমাদের একান্ত কামনা।
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]