শিরোনাম
জলজটের জলে ডোবার আগে-
প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০১৭, ১৬:০৩
জলজটের জলে ডোবার আগে-
প্রিন্ট অ-অ+

আমাদের একটা বদ্ধমূল ধারণা বা বিশ্বাস যে, ওপারেই (বিদেশে) সর্বসুখ। ওখানে কোনো দুঃখ নেই, কষ্ট নেই, সমস্যা নেই। আছে শুধু সুখ, আছে অপার শান্তি। ওখানে শীত আছে, তার চাইতেও বেশি করে আছে বসন্ত; চিরবসন্ত। বর্ষা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু জলজট, জলাবদ্ধতা এবং তজ্জনিত যানজট - সেরকম কিছু তো কল্পনাই করি না আমরা আমাদের ওই স্বপ্নের ভূখণ্ডে।


এ হলো উন্নত বিশ্ব নিয়ে আমাদের কল্পনা, কিন্তু বাস্তবতা পুরোপুরি না হলেও খানিকটা ভিন্ন। পাঠকের স্মরণ থাকলেও থাকতে পারে, কিছুদিন আগেই বিবার্তায় একটা স্টোরি ছাপা হয়েছিল, যার শিরোনাম ''জার্মানিতেও জলজট হয়''।


জার্মানি উন্নত মহাদেশ ইউরোপের উন্নততর দেশ, সেই দেশেও জলজট হয়! এ খবর আমাদের স্বপ্ন-কল্পনাকে একটু আঘাত করে বৈকি! তারপরও সত্য যা তা হলো, জার্মানির মতো উন্নত দেশেও জলজট হয়। আরো সত্য হলো, সেই জলজট ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থায়ী হয়ে জলাবদ্ধতার রূপ পরিগ্রহ করে না। কেন - সে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে পরে আসছি। তার আগে দেখা যাক আমাদের অবস্থা কী।


দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী নামে খ্যাত চট্টগ্রামের অবস্থা তো ক'দিন ধরে মিডিয়ায় প্রকাশিত ও প্রচারিত হচ্ছেই। ওই নগরের প্রায় পুরো অংশেই এখন বুকসমান পানি। গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র খাতুনগঞ্জে পানি ঢুকে শত শত কোটি টাকার পচনশীল পণ্য নষ্ট হয়ে গেছে। আগামী দিনগুলোতে এর খেসারত ভোক্তাদের কীভাবে দিতে হয়, ভাবতেই বুক কাঁপছে।


এ তো গেল চট্টগ্রামের অবস্থা, এবার ঢাকায় ফিরি। চট্টগ্রামের যে পরিস্থিতি, তাতে নিষ্কাশনব্যবস্থার অপ্রতুলতার সঙ্গে যোগ হয়েছে সমুদ্রের জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধি (মেয়রের ভাষ্যমতে) এবং কাপ্তাই হ্রদের গেট খুলে দেয়া। ঢাকায় কিন্তু এসব কারণের কোনোটিই কার্যকর নয়। ঢাকায় হয়েছে শুধু বৃষ্টি; কখনো থেমে থেমে, কখনো টানা। আর এতেই জলজট ও যানজটে চরম ভোগান্তিতে পড়ে রাজধানীবাসী। বিশেষ করে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী ও অফিসগামী মানুষের কষ্ট সীমা ছাড়িয়ে গেছে। রাজধানীর প্রায় অধিকাংশ সড়ক পানিতে ডুবে গেছে। সুযোগ বুঝে রিকশাওয়ালা ও সিএনজিচালকেরা ভাড়া হাঁকে দ্বিগুণেরও বেশি। মোটরসাইকেলে করেও মাত্র চার কিলোমিটার রাস্তা যেতে দেড় ঘণ্টা সময় লেগেছে বলে জানান এক যাত্রী। বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর ও মিরপুর রোডের সংযোগ সড়কে প্রায় বুকসমান পানি জমে যেতে দেখা যায়। এছাড়া গ্রিন রোডে অনেক জায়গায় এবং মিরপুর, বাড্ডা, রাজারবাগ, পুরান ঢাকাসহ অধিকাংশ এলাকায় দুই থেকে চার ফুট পর্যন্ত পানি জমে যায়।


ফিরে যাই জার্মানির উদাহরণে। সেদেশেও জলজট হয়, কিন্তু মানুষের এমন দুর্দশা হয় কি? অবশ্যই নয়। হলে মিডিয়ার কল্যাণে আমাদের তা অজানা থাকতো না। কিন্তু কেন হয় না? হয় না কারণ ওদেশের মানুষ সচেতন এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসন দায়িত্ব পালনে তৎপর।


তার বিপরীতে আমাদের অবস্থা কী? প্রথমেই বলি, নগরবাসী হিসেবে যেসব নাগরিক দায়িত্ব আমাদের পালন করার কথা, তা তো আমরা পালন করিই না, উল্টো তার বিপরীতই করি। এই যে আমাদের এই প্রিয় নগরীর পুরনো দিনের সবগুলো খাল অপদখল হয়ে গেলো, এর দায় কেবল সরকার বা সরকারি সংস্থাগুলোর ওপর চাপিয়ে দিয়েই পার পাওয়া যাবে? ড্রেনগুলো যে ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি, এর একটা বিরাট অংশই কি আমরা ফেলিনি? আমরা কখনো কি ভেবেছি যে, এই দেশটা শুধু কোনো সরকার বা সংস্থার নয়, আমাদের সকলের এবং তাই দেশটাকে সুন্দর ও বাসযোগ্য রাখতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য আছে। না। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমরা সেই দায়িত্ব-কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন ছিলাম না, যার পরিণাম আজ সবাইকে ভোগ করতে হচ্ছে।


মিউনিসিপাল কর্পোরেশন ও সরকারি সংস্থাগুলোর দায়িত্ব-কর্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তো যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে। প্রতি বছর সরকার এদের বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। সেই টাকা কীভাবে কীভাবে যেন তারা খরচও করে থাকে। কিন্তু তাতে জনগণের কী লাভ হয়, সেটা জটিল হিসেবের বিষয়। যেমন নগরীর ড্রেনগুলো পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব ওয়াসার। এ কাজ করার জন্য তাদের হাতে কোটি টাকা দামের সাকার মেশিনও নাকি আছে। কিন্তু সেই মূল্যবান মেশিন কখনো কোনো ড্রেনে মুখ ডুবিয়েছে, এমন অপবাদ শত্রুও দিতে পারবে না। জানতে ইচ্ছা হয়, ড্রেনগুলো তাহলে পরিষ্কার করবে কোন ভূতে?


বর্ষার আগে আগে এই নগরে রাস্তা কাটাকাটির ধুম পড়ে যায়। ঠিকাদার মশায়রা অল্প কিছুদূর কেটেই কেন যেন ক্লান্ত হয়ে কোথায় উধাও হয়ে যান। মাঝপথে কাজ ফেলে রেখে পলাতক ঠিকাদার গোষ্ঠীকে ঘাড় ধরে কাজের গোড়ায় এনে কাজ শেষ করানোর দায়িত্বটা কার, কাজদাতা সিটি কর্পোরেশনের নয় কি?


এ রকম উদাহরণ আরো অনেক দেয়া যায়। এই ব্যাপক অদক্ষতা, অমনোযোগিতা ও উদাসীনতার দায়ভার কিন্তু কোনো-না-কোনোভাবে সরকারের কাঁধেই চাপে। অথচ সরকার ঠিকই বছর বছর ওদের তহবিল যোগান দিয়ে যাচ্ছে।


একদিন-দু'দিনের বৃষ্টিতে নগর ডুবে যাওয়াটাকে খুব সহজ ও স্বাভাবিকভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কৈফিয়ত অনেক দেয়া যায়, যুক্তিও অনেক খাড়া করা যায়, কিন্তু যুক্তির জলে কি আর সবসময় জনতার মন ভেজে? জট লাগা জলে ডুবে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে হলে চাই সক্রিয় ও সচেতন হওয়া। সংশ্লিষ্টরা কি তা হবেন?

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com