শিরোনাম
মৌলভীবাজার বিআরটিএতে ঘুষ বাণিজ্য
প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৯:৩৯
মৌলভীবাজার বিআরটিএতে ঘুষ বাণিজ্য
তানভীর আঞ্জুম আরিফ, মৌলভীবাজার থেকে
প্রিন্ট অ-অ+

কোন রকম আইন-কানুন না মেনে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে করা হচ্ছে সিএনজি অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নীরব ভূমিকায় মৌলভীবাজারের বিআরটিএ (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি) অফিসে চলছে দালালদের রমরমা বানিজ্য চিত্র।


বিআরটিএ মৌলভীবাজার অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আতাত করেই চলছে এ ঘুষ বাণিজ্য।


সকলের চোখ উপেক্ষা করেই যেনো অবাধে চলছে এসব দুর্নীতি। ফলশ্রুতিতে প্রতিনিয়তই বাড়ছে রেজিট্রেশন করা সিএনজি অটোরিকশার পরিমান। সিলেট জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অটোরিকশার পরিমান সাড়ে ৩ হাজারের মধ্যে থাকার কথা ছিলো। কিন্তু বর্তমানে রেজিট্রেশনকৃত সিএনজি অটোরিকশার পরিমান এসে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজারের উপরে, যা সিলেট বিভাগের সব জেলার অনুমোদিত সিএনজির চেয়ে প্রায় ৫ গুণ বেশি।


অভিযোগ রয়েছে, ঘুষের বিনিময়ে একটি চক্র কাজ করায় তিন চাকার কাছে হার মেনেছে চার ও ছয় চাকার পরিবহনগুলো। অদক্ষ চালকরা প্রতিনিয়তই ঘুস দিয়ে লাইসেন্স সংগ্রহ করে নিচ্ছে, যাদের গাড়ি চালনা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা টুকুও নেই। যার দরুণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে সড়ক দুর্ঘটনা। এতে করে প্রাণ হারাচ্ছেন হাজারো মানুষ। আর বাস না থাকায় চরম বিপাকে রয়েছে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা।


অন্যদিকে রাস্তার ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত সিএনজি অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশন দেয়ায় চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন জেলার বিভিন্ন অটোরিকশা মালিক সমিতি। এতে করে বন্ধ হয়ে গেছে শত শত বাস ও মিনিবাস। এদিকে নিরুপায় হয়ে সম্প্রতি সিলেট বিভাগীয় কমিশনার বরাবর এরকম অভিযোগ দায়ের করেছে বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতির সদস্যরা।



সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলায় সরকারিভাবে নির্ধারিত ৩ হাজার ৫০০টি সিএনজি অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশন হওয়ার পর জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সিদ্ধান্ত মতে মৌলভীবাজার জেলায় আর কোনো সিএনজি অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশন না দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কোটি কোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্য ও অবৈধ উৎকোচ নিয়ে গোপন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মৌলভীবাজার জেলায় সিরিয়াল থ-১১-১০০০০পর্যন্ত সিএনজি অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয় প্রায় ১০ হাজার এবং এখন পর্যন্ত মৌলভীবাজার থ-১২ সিরিয়ালে ৫হাজার সিএনজি অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়েছে। ১১ ও ১২ সিরিয়াল মিলিয়ে মোট ১৫হাজার সিএনজি অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়েছে।


মৌলভীবাজার শমসেরনগর বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতির সদস্য মো. শাহজাহান চৌধুরী বিবার্তাকে অনেকটা ক্ষোভের কণ্ঠেই জানান, সিএনজি অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশন এখন সম্পূর্ণ প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে এবং টাকার কাছেই নতজানু।


সংশ্লিষ্ট অফিস কর্তাদের উদোর ভারী করা হয়েছে। যে কারণে সিএনজি অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশন ক্রেতা জনসাধারণ সব সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসন ও বিআরটিএ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাটুকুও গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ শোনা যায়। কোটি কোটি টাকার গোপন ঘুষ বাণিজ্য সবার মুখ বন্ধ করে রেখেছে। জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে মৌলভীবাজার জেলার বিআরটিসি’র বিভিন্ন সময়ের সভাপতি সদস্যদের উপরও।


গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর সিলেট বিভাগীয় কমিশনার বরাবরে মৌলভীবাজার শমসেরনগর বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতির লিখিত অভিযোগে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলার রাস্তার ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত ১৫ হাজার সিএনজি অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশন দেয়ায় জেলার বিভিন্ন মালিক সমিতি ব্যবসায়িকভাবে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। অনেক মালিক সমিতি বিপন্ন ও বিলীন হয়ে পড়েছে। বর্তমানে শত শত বাস ও মিনিবাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সরকার প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যায় ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে অতিরিক্ত সিএনজি অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশন দেয়ায় চরম আকারে প্রভাব পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর। একদিকে দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অপরদিকে সারা জেলায় মানুষকে প্রতিনিয়তই যানজট পোহাতে হচ্ছে। অপরদিকে অভ্যন্তরীণ সড়কে মিনিবাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লোকাল যাত্রীদের পাশাপাশি হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা পড়েছে চরম বিপাকে।


শমসেরনগর ও শ্রীমঙ্গল বাস মালিক সমিতির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী বিবার্তাকে জানান, বাস মালিকরা বর্তমানে খুব কঠিন সময় পর করছেন, অনেকই আবার বাসের কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে বিক্রি করেছেন নিজের ভিটা-বাড়ি। ইতিমধ্যেই মৌলভীবাজার শমসেরনগর বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতির গাড়িগুলো চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সর্বোপরি জেলায় চালিত বাস ও মিনিবাস মালিকরা ব্যবসায়িকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত। ফলশ্রুতিতে এই ব্যবসা বন্ধের উপক্রম হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।


বর্তমানে মৌলভীবাজার, কুলাউড়া, বড়লেখা, জুড়ী বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতি এবং মৌলভীবাজার শ্রীমঙ্গল শেরপুর মিনিবাস মালিক সমিতি ও মৌলভীবাজার মিনিবাস মালিক গ্রুপের মালিকরা ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এ কারণে জেলায় পরিবহন সেক্টরে যে কোনো সময় অপ্রীতিকর ঘটনায় আইশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা বিরাজ করছে বলে অভিযোগ করেছেন মৌলভীবাজার শমসেরনগর বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতি। তারা এ ব্যাপারে সিলেট বিভাগীয় কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছে বলে জানা গেছে।


এছাড়া মৌলভীবাজার রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) এডিশনাল ডাইরেক্টর (এডি) জয়নাল আবেদীন নিয়মিত অফিসে উপস্থিত থাকেন না বলেও অভিযোগ উঠেছে।



এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) এডিশনাল ডাইরেক্টর (এডি) জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে বার বার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও উনাকে পাওয়া যায়নি। পরে মৌলভীবাজার বিআরটিএ’র ফিল্ড মেকানিক্যাল মো. জামাল বিবার্তাকে জানান, গত ২ মাস থেকে মৌলভীবাজারে সিএনজি অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশন বন্ধ রয়েছে। এ সময় তিনি জানান, ১১ সিরিয়ালে ১০ হাজারের পর ১২ সিরিয়ালে বেশ কিছু দিন আগে দেখেছিলেন ৪ হাজার ৮০০ টি সিএনজি রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। বর্তমানে এর সঠিক সংখ্যা না দেখে বলতে পারবেন না তিনি। তবে বিআরটিএ অফিসের ঘুষ বাণিজ্যের বিষয়টি কথা টানলে এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি তিনি বরং এই প্রতিবেদককে দেখা করার প্রস্থাব ও রাখেন এই কর্মকর্তা।


মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম অতিরিক্ত সিএনজি অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশনের সত্যতা নিশ্চিত করে বিবার্তাকে জানান, তিনি মৌলভীবাজারে যোগদানের পর থেকে নতুন করে সিএনজি অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশনের কোনো অনুমোদন দেননি এবং নতুন করে আর সিএনজি অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশনে অনুমোদন দেয়া হবে না। অনুমোদন না দেয়ার ব্যাপারে ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা এসেছে বলে তিনি অবিহিত করেন।


এদিকে মৌলভীবাজার শমসেরনগর বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ১৭ জানুয়ারি সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার (সাধারণ) মো. শাহাদাত হোসেন স্বাক্ষরিত এক পত্রে জেলার পরিবহন ব্যবস্থা ও জনস্বার্থ বিবেচনায় সিএনজি অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশন বন্ধ রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসককে নির্দেশ করেন।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন বাস মালিক সমিতির সিলেট বিভাগীয় কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মফস্বিল আলী বিবার্তাকে জানান, মৌলভীবাজার জেলায় সহস্রারাধিক বাসের মধ্যে এখন ২০০ বাসও নেই। বেকার হয়ে পড়ে আছেন অনেক শ্রমিক। মালিকরা বাধ্য হচ্ছেন গাড়ি বিক্রি করে দিতে। নতুন করে কেউ-ই বাস কিনছেন না।


এ ব্যাপারে ঢাকা সিলেট মহাসড়কের যাত্রী পরিবহনের চালক মো. নানু মিয়া বিবার্তাকে জানান, এক সময় ঢাকা থেকে মৌলভীবাজার সাড়ে ৩ ঘণ্টায় আসতে পারতেন। এখন রাস্থায় সিএনজি অটোরিকশা বেড়ে গেছে যার ফলে ঢাকা থেকে মৌলভীবাজার আসতে সময় ব্যয় হয় ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা।



বিবার্তা/আরিফ/আমিরুল

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com