শিরোনাম
এ সখি পেখনু অপরুব গোরি
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০১৬, ১১:০০
এ সখি পেখনু অপরুব গোরি
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

ব্যাকরণ অনুযায়ী অপরূপ শব্দের অর্থ ‘কুরূপ’ বা ‘বাজে রূপ’ ছাড়া অন্য কিছু নয়। অথচ শব্দটি সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থেই বাংলা ভাষায় বেশ দাপটের সঙ্গেই চলছে। অথর্ববেদে অপরূপ শব্দটি ‘অপকৃষ্ট রূপ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে বাচস্পত্য অভিধানে অপরূপের অর্থে বলা হয়েছে ‘আশ্চর্য রূপ’।


আর কৃষ্ণচন্দ্রচরিতে অদ্ভুত ও বিস্ময়কর অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে (অপরূপ দেখ আর, ওরে ভাই কর্ণধার, কমলে কামিনী অবতার)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ‘শরৎ’ কবিতায় অদ্ভুত অর্থে শব্দটি ব্যবহার করেছেন (শরৎ এনেছে অপরূপ রূপ-কথা, নিত্যকালের বালক বীরের মানসে)। আহসান হাবীবও একই অর্থে শব্দটি ব্যবহার করেছেন (অশেষ আশার দিন পলাতক, আজো মিলায়নি ছায়া? আজো দিগন্তে স্বপ্নের মতো তারি অপরূপ কায়া)।


আসলে একই অর্থে অপরূপ শব্দটি অনেকেই ব্যবহার করেছেন (আর বন্যার মতো পুত্রকন্যা, অরণ্যে রোদন, হে ঈশ্বর একী অপরূপ- সমর সেন; রূপহীন মরণেরে মৃত্যুহীন অপরূপ সাজে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; কিবা অপরূপ রূপ হেরি তরুতলে- ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর)।


প্রাচীন বাংলায় অপূর্ব বা অপরূপ অর্থে ‘অপরুব’ শব্দটি চালু ছিল (এ সখি পেখনু অপরুব গোরি- বিদ্যাপতি)। অন্যদিকে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রয়েছে অপুরুব (অপুরুব কুচ চক্রবাক যুগল)। তবে দীর্ঘদিন ধরে অপরূপ শব্দটিই বেশি চলছে (অপরূপ সুন্দরী রাজকন্যাকে দেখে রাজপুত্র বজ্রকূট একেবারে বিমোহিত হয়ে গেলেন- বেতাল পঞ্চবিংশতি, ঈশ্বচন্দ্র বিদ্যাসাগর; আর এক অপরূপ কহিতে নারি। যেথা মেঘ সেথা না হয় বারি- জ্ঞানদাস)।


সুভাষ ভট্টাচার্য তাঁর ‘বাংলা প্রয়োগ অভিধান’-এ অপরূপ শব্দের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, ‘শব্দটি তৎসম নয়। দুটি অর্থ এর। প্রথম অর্থ অতুলনীয় সৌন্দযবিশিষ্ট বা অপূর্ব। দ্বিতীয় অর্থ একেবারেই ভিন্ন, কিম্ভুত, অদ্ভুত। প্রথম অর্থে শব্দটি প্রাকৃত ‘অপরুব’ থেকে এসে থাকতে পারে। দ্বিতীয় অর্থে অপ (অপগত) + রূপ- এ রকম একটা উৎস ভাবা যেতে পারে।’


সংস্কৃত পণ্ডিত পরেশচন্দ্র মণ্ডল ‘কুরূপ’ অর্থে অপরূপ শব্দের ব্যাখ্যা মানেননি। তিনি তার ‘ভাষাবিদ্যা পরিচয়’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, ‘অপূর্ব’ শব্দ থেকেই অপরূপ শব্দটি এসেছে। তিনি শব্দটির বিবর্তন দেখিয়েছেন এভাবে: অপূর্ব>অপুরব (স্বরভক্তি হেতু) > (লোকনিরুক্তি হেতু)।


‘অপ’ থাকা সত্ত্বেও শব্দটি কেন বেদ-কথিত ‘কুরূপ’ অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে ‘অপরূপ’ শব্দটি পরবর্তীকালে ‘অতুলনীয়-রূপ’ অর্থে ব্যবহৃত হতে শুরু করে, তার ‘লুপ্তসূত্র’টি দিয়ে গেছেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মতে ‘বাচস্পত্যে ‘আশ্চর্য্যরূপ’ অর্থে সংস্কৃত ‘অপরূপ’ ধৃত হইয়াছে।’ সম্ভবত ততদিনে নিজেকে আরও সুন্দর করে দেখিয়ে সৌন্দর্যমুগ্ধকে পাওয়ার ‘আশামূলক আচরণ’ সমাজে শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাই নিন্দনীয় ‘অপরূপ’ই ‘আশ্চর্য্যরূপ’ অর্থাৎ wonderful-রূপ হয়ে যায়। তবে অতীতে যেমন ব্যক্তিগত-সম্পত্তি নিন্দনীয় ছিল, পরে গৌরবজনক হয়ে যায়; তেমনই এই ‘অপরূপ’ও ক্রমে গৌরবজনক হয়ে যায়।’


ড. হুমায়ুন আজাদের ‘তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান’ মতে, ‘অপরূপ শব্দটি নির্দেশ করতো ‘শ্রীহীনতা’, এখন এটি নির্দেশ করে অনির্বচনীয় সৌন্দর্য।’ অসমিয়ায় অপরূপ, মৈথিলীতে অপরুপ, মরাঠিতে অপরুপ।


অন্যদিকে সংস্কৃত অ + পারক= অপারক। শব্দটির অর্থ পারক নয় এমন, অক্ষম, অসমর্থ। কিন্তু ঘোষীভবন বা vocalization এর কারণে অপারক হয়ে গেছে অপারগ। দুটোই শুদ্ধ। তবে এখন অপারককে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে অপারগ (যিনি রংটা নীল কিংবা সবুজ বিশেষ ঠাওর করেও বলতে অপারগ- প্রমথ চৌধুরী)। অপারগের বিপরীত হিসাবে সুপারগ শব্দটিও বাংলায় চালু রয়েছে (বিচারে সুপারগ ছিলেন। তাহার কারণ এই দেশের ভাষা ও রীতি ব্যবহার ও ঘাঁৎঘুৎ সকল ভাল বুঝিতেন- আলালের ঘরের দুলাল, টেকচাঁদ ঠাকুর।)


তবে অপারক শব্দেরও ব্যবহার রয়েছে (শব্দের ঘটায় ও বাক্যের ছটায় উত্তেজনার সৃষ্টি করতে আমি অপারক- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)।


জিয়াউদ্দিন সাইমুমের ব্লগ থেকে


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com