আজকাল যখন ঢাকায় যাই বা ভারতের কোনো মহানগরীতে, মনে হয় কেন কুম্ভকর্ণ হয়ে জন্মাইনি? তেমনটা হলে কী ভালোই না হতো! দেশে গিয়ে আজও কেমন আয়েশ করে ঘুমাতে পারতাম৷ কোনো শব্দই আমার ঘুম ভাঙাতে পারতো না!
খুব ছোট্টবেলার কথা। তখনও ঘুম ভাঙতো কোনো-না-কোনো শব্দ শুনে - মোরগের ডাকে, পায়রার বাকবাকুম অথবা প্রতিবেশীর গলা সাধার শব্দ। মা-ও টেনে উঠিয়ে দিতেন। বলতেন, পড়তে বসো অথবা পাশের বাড়ি রিংকুর মতো সা-রে-গা-মা করে গলাটা একটু ঝালিয়ে নাও। কে কার কথা শোনে? চাদরটা আবারো মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতাম দু'চোখ বন্ধ করে। কানে আসতো শীতলা মন্দিরের ঘণ্টার ধ্বনি অথবা মসজিদের আজান। কাগজওয়ালা কাগজ দিয়ে যেত, ভারি দিয়ে যেত জল৷ রিকশার টুংটাং, ফেরিওয়ালার হাঁকাহাঁকি, বাঁশিওয়ালার সুর, রান্নাঘরে ছ্যাৎ করে কড়াইতে মশলা ছাড়া অথবা মাছ ভাজার শব্দ – এভাবেই শুরু হতো সকালটা।
না, আমি কোনো পাড়াগাঁয়ে বড় হইনি। ছোটবেলার বেশিরভাগই আমার কেটেছে কলকাতা অথবা ঢাকায়। বিশ্বাস হচ্ছে না? আসলে আজকাল আমারই তো বিশ্বাস হয় না। আজকাল দেশে গেলে বেশিরভাগ সময়ই কানে তুলো দিয়ে রাখি। ভাই ব্যঙ্গ করে বলে, ‘‘দিদিটা বিদেশি হয়ে গেছে।''
কথাটা ঠিক কিনা জানি না, তবে ঢাকা-কলকাতা-দিল্লি-মুম্বই – এ সব শহরে জানলা খুললেই গোটা পৃথিবীটা যেন ঝমঝম করে ওঠে। বাড়িতে বাড়িতে তারস্বরে চলছে টেলিভিশন আর রাস্তায় ক্রিকেট বা ফুটবলের ধারাবর্ণনা অথবা মাইকে মাইকে হিন্দি গান – তা সে পুজো হোক বা ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প।
আসলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে উন্নত জীবনশৈলীর প্রতি মানুষের আগ্রহ। উন্নত জীবন মানেই নাকি টপ-মডেলের গাড়ি, বিরাট স্ক্রিনের টেলিভিশন, ডলবি সাউন্ড-সিস্টেম সমৃদ্ধ মিউজিক সিস্টেম, আরো কত কী!
মনে পড়ে, ছোটবেলায় একবার শান্তিনিকেতনে যাচ্ছিলাম। পথে বেশ যানজট ছিল, আমাদের গাড়িটা কিছুতেই এগোতে পারছিল না। সামনে যে ছিল একটা অতিকায় ট্রাক, তার পেছনভাগে লেখা – ‘জোরে জোরে হর্ন দিন'। সেই ‘হর্ন' দেওয়াই যে এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে হর্ন দেওয়ার মাত্রাও। কারুর যে আজ আর সময় নেই! তথাকথিত জীবনযুদ্ধে বেরিয়ে পড়েছে মানুষ! আপনি একটু ধীর গতিতে পা ফেলেছেন কি আপনাকে ঠেলে-গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য নিমিষের মধ্যে এগিয়ে আসবে অসংখ্য হাত, হয়তবা পা-ও। তাই তো বলছি – অভিধানে লিখে নিন, এরই নাম ‘উন্নয়ন'।
ভারতের রাজ্যে রাজ্যে আজ পানীয় জল নেই, লক্ষ লক্ষ মানুষের নেই দু'বেলা পেট ভরে খাওয়ার খাবার, নেই সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থাও। কিন্তু তাতে কী? আমাদের যে স্যাটেলাইট আছে, পারমাণবিক অস্ত্র আছে, বিদেশি গাড়ি, দিল্লির অদূরে গুরগাঁও বা মুম্বইয়ের কাছে থানের মতো ‘হাই-টেক মেগা-সিটি' আছে। আছে আগাছার মতো গড়ে ওঠে কলকারখানা। আর তার সঙ্গে আছে শব্দদূষণ।
জোর যার, মুলুক তার – আপামর ভারতবাসী শুধু নয়, দক্ষিণ এশিয়ার সমস্ত মানুষই যেন এই মন্ত্রেই দীক্ষিত। তাই শ্রুতিসীমা অতিক্রমকারী শব্দ সৃষ্টি তারা করছে নিজেদের ইচ্ছেতেই। এতে করে পাশের মানুষ, পাশের গাড়ি, প্রতিবেশী বা নিজের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলো কিনা, তা নিয়ে চিন্তা করার সময় আছে নাকি কারুর? এই উপমহাদেশে তো পরিবেশ দূষণের জন্য রাস্তায় রাস্তায় আতশবাজি বন্ধ করলে, মানুষ বাড়ির ছাদে গিয়ে বাজি পোড়ায়। ফায়ারব্রিগেড বা অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ এলে রাস্তা ছেড়ে দেয়ার বদলে ''মহামূল্যবান কাজে'' দেরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে সেই গাড়ির আগে অথবা ফাঁকা রাস্তার আশায় তার পিছনে গিয়ে লাইন লাগায়।
ক'দিন আগে ট্যাক্সি থেকে নামার সময় কিছুতেই টাকার ব্যাগটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ছোট্ট গলি, তার ওপর রাতও হয়েছে, আমারও তাড়া আছে। কিন্তু কোন ব্যাগের মধ্যে মানিব্যাগটা রাখলাম? পিছনে ততক্ষণে অন্য একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। আমার অস্বস্তি হতে শুরু করলো। কিন্তু ট্যাক্সি-ড্রাইভার বললেন, অসুবিধা নেই, আপনি ধীরে-সুস্থে খুঁজুন। এটা ‘ওয়ানওয়ে'। যতক্ষণ না আপনার টাকা দেয়া শেষ হবে পিছনের গাড়ির কিছু করার নেই। ওকে দাঁড়াতেই হবে, হর্নও দিতে পারবে না।
ভাবছেন, এমন আবার হয় নাকি? হয়, কারণ দেশটা জার্মানি। এ ঘটনা যদি ভারত বা বাংলাদেশে ঘটতো, তবে আমি তো বটেই, ট্যাক্সি-ড্রাইভারও নিশ্চয় মার খেয়ে যেতেন। আর হর্নে হর্নে কানের পর্দাটাই হয়ত যেতো ফেটে। জার্মানি বলেই তেমনটা হয়নি, বরং পেছনের গাড়িটি প্রায় মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে আমি টাকা দিয়ে নেমে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল।
বিজ্ঞান বলে, মানুষ সাধারণত ২০ থেকে ২০ হাজার ডেসিবেলের কম বা বেশি শব্দ শুনতে পায় না। ভারত ও আশপাশের দেশগুলোর যা অবস্থা, তাতে এমনটা চললে সেদিন আর দূরে নেই, যেদিন আমরা সবাই বধির হয়ে যাবো।
তাই তো আজকাল দেশে গেলে কখনও ছেলেবেলার সেই বাঁশিওয়ালাদের খুঁজি। আবার কখনও মনে হয়, আহা, আমিও যদি কুম্ভকর্ণের মতো অঘোরে ঘুমাতে পারতাম!
দেবারতি গুহের ব্লগ থেকে
বিবার্তা/হুমায়ুন/কাফী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]