শিরোনাম
জার্মানিতে কি ঘুষ আছে?
প্রকাশ : ১৭ জানুয়ারি ২০১৮, ১৮:৩৫
জার্মানিতে কি ঘুষ আছে?
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

জীবনের অর্ধেক কাটিয়েছি উপমহাদেশে, বাকি অর্ধেক জার্মানিতে। তাই যখন কেউ জানতে চান, তফাৎটা কোথায়? আমি বলি : ‘‘জার্মানিতে ৩৫ বছর কাটালাম বিদেশি হিসেবে। কিন্তু আজ অবধি কোনো কাজের জন্য চেনাশোনা কোনো কর্তাব্যক্তিকে টেলিফোন করতে হয়নি। অর্থাৎ বলতে বা তাকে দিয়ে বলাতে হয়নি, তা সে টেলিফোন কনেকশানই হোক আর ভিসার মেয়াদ বাড়ানোই হোক। আর ঘুষ?''


জার্মানির কথা বলার আগে দেশের দু'টো অভিজ্ঞতার কথা বলি। বহু যুগ আগে যখন রাতের প্যাসেঞ্জারে থার্ড ক্লাস টু-টায়ার কম্পার্টমেন্টে রিজার্ভেশন ছাড়া চেপে হাওড়া থেকে পুরুলিয়া যেতাম, তখন সরকারবাবু নামের এক গার্ড ট্রেন ছাড়বার পরে বাকি বার্থগুলো বিলি করতেন এই বলে: ‘পয়সা তো দিতেই হবে। তা কোন সরকারকে দেবেন? এই সরকারকে, না ভারত সরকারকে?' জার্মানিতেও গার্ডরা সিট রিজার্ভেশন বিলি করে থাকেন, তবে সেজন্য কোনো গার্ড কখনো পয়সা নিয়েছেন বলে আজ পর্যন্ত শুনিনি।


দ্বিতীয় কাহিনি, এটাও ট্রেনের। দেশে গেছি, যাব কলকাতা থেকে দিল্লি। ছোটভাই রেলের অফিসার, সে-ই বলে দিয়েছিল, তাই অত কম সময়ের মধ্যেও যাহোক একটা রিজার্ভেশন পাওয়া যাচ্ছিল। বুকিং অফিসে গিয়ে ভাইয়ের নামধাম বললাম; কাউন্টারের ক্লার্কটি সঙ্গে সঙ্গে টিকিট করে দিলেন – সে আমলে ৯০ টাকার কিছু বেশি। এক শ' টাকার নোট দিয়ে খুচরোর অপেক্ষায় আছি, দেখি ক্লার্ক ''ভদ্রলোক'' নড়াচড়া করে না। আমতা আমতা করে বললাম: ‘বাকিটা?' করণিক মহোদয় অবাক হয়ে বলল : ‘সে কি, পান খাওয়ার পয়সা দেবেন না?' আমাকে পাঠিয়েছে কিন্তু তার অফিসার।


আমার থিওরি হলো, কর্মচারীদের যদি বেঁচে থাকার মতো সঠিক মাইনে না দেয়া হয়, তবে তারা নিজেরাই কাস্টমারদের ওপর ঘুষের সারচার্জ বসিয়ে মাইনে বাড়িয়ে নেবে। জার্মানিতে মানুষজনের মাইনে এত বেশি যে, তাদের চুরি করার দরকার পড়ে না। তার কারণ – আমার আরেক থিওরি – পৃথিবীতে আসলে চোর বলে কিছু নেই, আছে শুধু গরিব লোক। জার্মানিতে একজন বাস ড্রাইভারের মাইনে ইউরোপের অন্যান্য অনেক দেশের প্রফেসরদের সমান। কাজেই এ দেশের সাধারণ লোক ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করে না।


এদেশে হয় পুকুর চুরি। জার্মানিতে ঘুষ দেয়া-নেয়া আর দুর্নীতির খেলাটা খেলে প্রাইভেট কম্পানি আর রাজনীতিকরা – ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল। সে অনেক টাকার খেলা। অফিস থেকে প্রিন্টারের কাগজ নিয়ে যাওয়া, সরকারি কনট্র্যাক্টের ওপর নির্ভরশীল কোনো কম্পানিকে ডাকিয়ে নিখরচায় নিজের বাড়ির বাগানটা করিয়ে নেয়া অথবা কোনো ‘বন্ধু' কিংবা ‘শুভানুধ্যায়ী'কে দিয়ে হোটেলের বিলটা দিইয়ে নেয়া, জার্মানির এক সাবেক প্রেসিডেন্ট যা করতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছিলেন – এগুলোকে আমি চুরি না বলে ছ্যাঁচড়ামো বলি, যা সব দেশেই আছে।


এ দেশে ঘুষ বলতে মিলিয়ন্স, পিনাট্স নয় – অর্থাৎ কোটি কোটি টাকা এদিক থেকে ওদিক চলে যায়, যেন আকাশে এরোপ্লেন উড়ছে, মাটির মানুষ তা দেখতে পাচ্ছে না। জার্মান কম্পানিগুলো যত না ঘুষ খায়, তার চেয়ে বেশি দেয় বলে বাজারে তাদের দুর্নাম আছে, যেমন মধ্যপ্রাচ্যে কিংবা দক্ষিণ অ্যামেরিকায়। অন্যান্য হাতিমির বহুজাতিক কম্পানির মতোই জার্মান কম্পানিরাও পারলে প্রেসিডেন্ট কেনে, কেনে প্রাইম মিনিস্টার – কনট্র্যাক্ট চাই তো, না হলে কারখানার চাকা ঘুরবে কি করে?


এদেশে আরেকটা খেলা হলো, বড় বড় সরকারি প্রকল্প নির্মাণের সময় ও খরচ, দু'টোই বাড়তে থাকে চক্রবৃদ্ধি হারে। হামবুর্গের এলব ফিলহার্মনি, বার্লিনের বিইআর বিমানবন্দর, স্টুটগার্টের রেলওয়ে স্টেশন, কতো নাম করব। সর্বত্রই একই কাহিনী : গোড়ায় যা খরচ ধরা হয়, শেষমেষ তার পাঁচগুণ খরচ পড়ে, সময়ও লাগে অনেক বেশি। এক্ষেত্রে আমার থিওরি হলো, টাকা এদেশে বাতাসে উড়ছে। সেই টাকা ধরে খাওয়ার জন্য পাবলিক প্রকল্প লাগে। পাবলিক প্রকল্পের দেখাশোনার দায়িত্বে আবার রাজনীতি, কাজেই রাজনীতিকেও তো কিছু ফড়িং ধরে দিতে হবে?


বলতে কি, এদেশে এত টাকা যে, ২০১৫ সাল যাবৎ শুধু ভাঙাচোরা স্কুলের জিম বা ফেলে রাখা সেনাছাউনি সারিয়ে উদ্বাস্তু আবাস করেই অনেক ছোট থেকে মাঝারি কম্পানি লাল হয়ে গিয়েছে। এদেশে প্রতিটি শহর বা পৌর এলাকাকে এক-একজন উদ্বাস্তু নেয়ার জন্য বছরে ১০,৪০০ ইউরো বরাদ্দ করা হয়। আহা, একাত্তরের যুদ্ধের পর দণ্ডকারণ্য পুনর্বাসনের সময় যদি এরকম একটা তহবিল থাকত!


এককথায়, চুরি করার জন্য গাঁয়ের মাঝখানে যদি একটা বেওয়ারিশ কিন্তু বারোয়ারি পুকুর থাকে, তবে মানুষজন পরস্পরের ঘটিবাটি চুরি করতে যাবে কোন দুঃখে?


অরুণ শঙ্কর চৌধুরীর ব্লগ থেকে


বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com