শিরোনাম
সূতিকা সূত্র আর সূত্রপাত
প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০১৭, ০৮:৫৭
সূতিকা সূত্র আর সূত্রপাত
জিয়াউদ্দিন সাইমুম
প্রিন্ট অ-অ+

সংস্কৃতে সূতি মানে প্রসব। সূতিকা মানে নবপ্রসূতা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো বাংলায় সূতিকা মানে প্রসূতির রোগ বিশেষ (বৎসর পাঁচ-ছয় পূর্বে আমাদের প্রতিবেশিনী হতভাগিনী নিরুদিদি বালবিধবা হইয়াও যখন সূতিকা রোগে আক্রান্ত হইয়া ছয় মাস ভুগিয়া ভুগিয়া মরেন, তখন সেই মৃত্যুশয্যার পাশে আমি ছাড়া আর কেহ ছিল না- শ্রীকান্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)।


আবার বাংলায় সূতিকাগার মানে আঁতুড়ঘর। তবে শব্দটির প্রয়োগক্ষেত্র বেড়েছে। সূচনাভূমি অর্থে শব্দটির প্রয়োগ এখন বেশি চোখে পড়ে (সাহিত্য ও আধুনিক সংস্কৃতির সূতিকাগার তো এই চাঁদপুর- শামসুজ্জামান খান)।


সংস্কৃতে সূত্র মানে সুতা (যেমন একটা সুতাকে মাঝখানে লইয়া মিছরির কণাগুলা দানা বাঁধিয়া উঠে তেমনি আমাদের মনের মধ্যেও কোনো একটা সূত্র অবলম্বন করিতে পারিলেই অনেকগুলা বিচ্ছিন্ন ভাব তাহার চারি দিকে দানা বাঁধিয়া একটা আকৃতিলাভ করিতে চেষ্টা করে- সাহিত্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর), তন্তু, সংজ্ঞা (ইহারই মাঝে এক সময়ে হেরম্ব তত্ত্বরত্ন মহাশয় আমাদিগকে একেবারে ‘মুকুন্দং সচ্চিদানন্দং’ হইতে আরম্ভ করিয়া মুগ্ধবোধের সূত্র মুখস্থ করাইতে শুরু করিয়া দিলেন- জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; যাহা কাপিল সূত্র বলিয়া চলিত, তাহাই আমরা অবলম্বন করিয়া, অতি সংক্ষেপে সাংখ্যদর্শনের স্থূল উদ্দেশ্য বুঝাইয়া দিবার যত্ন করিব- সাংখ্যদর্শন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়), সম্বন্ধ (পরিণয়-সূত্র), সম্পর্ক (কোন সূত্রে এ তথ্য পেয়েছ?), আইনবিধি, শুরু (সূত্রপাত), ব্যপদেশ (বক্তা বোধ করি তাঁহার শেষ কথারই সূত্র ধরিয়া কহিলেন, আপনাদের প্রসঙ্গেই কথা কইতে তিনি আপনার সম্বন্ধে বলছিলেন, আপনি নাকি ভয়ানক হিন্দু, একেবারে গোঁড়া- পথের দাবী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)। কিন্তু নাট্যশাস্ত্রে সূত্র ভিন্ন জিনিস। সংস্কৃত নাট্যশাস্ত্রে বলা হয়েছে ‘স্বল্পাক্ষরমসন্ধিগ্ধং সারবৎ বিশ্বতোমুখম। অস্তোভমনবদ্যঞ্চ সূত্রং সূত্রবিদো বিদুঃ’- অর্থাৎ স্বল্পাক্ষর বিশিষ্ট সন্দেহমুক্ত সারবান সর্বতোগামী সফল এবং নির্দোষ বাক্যই সূত্র বলে পণ্ডিতদের দ্বারা অভিহিত হয়েছে।


অন্যদিকে ‘সূত্রপাত’ শব্দটির জন্য বাংলা ভাষা ঋণী ছুতোর মিস্ত্রি ও রাজমিস্ত্রির কাছে। তারা সুতো পেতে বা ফেলে সোজা লাইন টানেন বা লাইন সোজা করেন। বিশেষত স’ মিল বা করাত-কল আবিষ্কারের আগে ছুতোর মিস্ত্রি বা সূত্রধররা কাঠ চেরাই-ফাঁড়াইয়ের আগে কালি মাখানো সুতো কাঠের ওপর ফেলে সোজা লাইন এঁকে নিতেন। কাঠের ওপর সুতো ফেলে কাজ শুরু করার কাজটিই একদিন সূত্রপাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। এখন শব্দটির অর্থের সম্প্রসারণ ঘটেছে। এখন যে কোন কাজ শুরুর প্রক্রিয়াটিই সূত্রপাত (কবে এবং কি হইতে ইহার সূত্রপাত, সে কথা ইতিহাস লেখে না- নারীর মূল্য, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; ভারতবর্ষীয় ইতর লোকের অনুন্নতি ধারাবাহিক; যতদিন হইতে ভারতবর্ষে সভ্যতার সৃষ্টি, প্রায় ততদিন হইতে ভারতবর্ষীয় কৃষকদিগের দুর্দ্দশার সূত্রপাত- সাম্য, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; মুর্শিদাবাদের নওয়াবের সহিত টেক্কা দিয়া বিলাসিতা করিতে গিয়াই নাকি তাঁহাদের এই দুরবস্থার সূত্রপাত- পদ্মগোখরো, কাজী নজরুল ইসলাম)।


বাংলায় সুতো শব্দের সংস্কৃত রূপ সূত্র। আর ব্যাকরণগত দিক থেকে সূত্রকে পাতা বা স্থাপনই সূত্রপাত। শব্দটি এখন ভূমিকা, সূচনা, আরম্ভ অর্থে ব্যবহৃত হয় (চাকরদের মহলে যে সকল বই প্রচলিত ছিল তাহা লইয়া আমার সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত হয়- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; তখন দেশে স্বদেশী আন্দোলনের সূত্রপাত হইয়া গিয়াছে- বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, চতুর্থ খণ্ড, সুকুমার সেন)।


লেখাটি লেখকের ব্লগ থেকে নেয়া


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com