শিরোনাম
‘সাথে’ ‘সাধু’ আর ‘সাধ্য’
প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০১৭, ১১:৪২
‘সাথে’ ‘সাধু’ আর ‘সাধ্য’
জিয়াউদ্দিন সাইমুম
প্রিন্ট অ-অ+

প্রবীণ সাংবাদিক দিলীপ দেবনাথ তাঁর ‘বাংলা শুদ্ধ লিখুন ভালো লিখুন’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘চলতি গদ্যে এখন সাথে এমন দাপটের সঙ্গে চলছে যে, এর সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে ‘সঙ্গে’র চিড়ে চ্যাপ্টা হওয়ার জোগাড়।’ তারপরও বাংলাদেশের মিডিয়াপাড়ায় ‘সাথে’ শব্দটি কেটে ‘সঙ্গে’ করার একটা বাতিক রয়েছে। অথচ ‘সাথে’ শব্দটি এতোটাই গতিশীল ও প্রচলিত যে, এটার বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকার যুক্তি আর থাকার কথা নয় (আসমানী নীল রঙের সাথে জলঙ্গা নীল মেশে- সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত; গাজী মোস্তফা কামালের সাথে জেগেছে তুর্কী সূর্য তাজ- কাজী নজরুল ইসলাম; হেমাঙ্গিনী সঙ্গিনী দল সাথে- মাইকেল মধুসূদন দত্ত)। মজার বিষয় হচ্ছে, সাথে শব্দটার সঙ্গে লড়াই করে কবিগুরুও শেষ পর্যন্ত পিছু হটে বলেছেন, ‘পূর্ববঙ্গের ভাষায় সাথে শব্দের দাপট সত্যিই বেশি।’


তবে কবিতায় ‘সনে’ শব্দের ব্যবহারও কম নয় (সনাতি হইয়া থাকি সর্বলোক সনে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; হৃদয় স্পন্দন সনে ঘুরছে জড়ৎ, চলিছে সময়- অক্ষয় কুমার বড়াল)।


এক সময় গদ্যে পদ্যে সাথে অর্থে ‘সহিত’ বেশ চালু ছিল (চলে নীল শাড়ী নিঙাড়ি নিঙাড়ি পরাণ সহিত মোর- চণ্ডীদাস)। সংস্কৃত ‘সহিত’ থেকে ‘সঙ্গে বা সাথে’র উৎপত্তি।


এদিকে ‘সাধু’ শব্দের মূল অর্থ সৎব্যক্তি। তবে শব্দটি দিয়ে এখন প্রধানত ঋষি ব্যক্তি বোঝায় (কিছু দূর গিয়া সাধু দেখে ডেপুরা এককানি- পূর্ববঙ্গগীতিকা; বিনা অপরাধে আমারে ত্যজিয়া সাধু সাজিয়াছ ভালো, অন্নবসন বিহনে আমার বরণ হয়েছে কালো!- অপমানবর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; তেমনি বাংলাবাক্যাধীপেরও আছে দুই রানী, একটাকে আদর করে নাম দেওয়া হয়েছে সাধু ভাষা; আর একটাকে কথ্য ভাষা, কেউ বলে চলতি ভাষা, আমার কোনো কোনো লেখায় আমি বলেছি প্রাকৃত বাংলা- বাংলাভাষা পরিচয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; চোর ডাকাতেরা মাথা তুলিল, সাধু ভীত হইয়া ঘরের মধ্যে লুকাইল- আনন্দমঠ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; সাধু ইতিমধ্যে আমায় দেখিতে পাইয়া একটু বিস্ময়েরও বোধ হয় কথঞ্চিৎ ভয়ের সঙ্গে, সঙ্কুচিত হইয়া একপাশে দাঁড়াইয়া ছিল- আরণ্যক, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)।


সাধু শব্দের অন্যান্য অর্থের মধ্যে রয়েছে বিশেষণে ধার্মিক (সাধু লোক), শিষ্ট (সাধু ভাষা), ভালো (মাতার উদ্দেশ্য যে খুব সাধু, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই- প্রমথ চৌধুরী), সুষ্ঠু বা যথাযোগ্য (সাধু প্রয়োগ) এবং বিশেষ্যে সন্ন্যাসী, বণিক। অথচ এক সময় সাধু তাদেরকেই বলা হতো যারা ব্যবসা করতে গিয়ে লোক ঠকাতো। সাধু শব্দের গঠন হচ্ছে সংস্কৃত সাধ্ + উ।


তবে ‘সাধ্য’ শব্দের সংস্কৃত ও বাংলা প্রয়োগে পার্থক্য আছে। সংস্কৃতে সাধ্য মানে যা করতে পারা যায়, সাধনীয়, সম্পাদ্য (তিন মাসে সাধ্য), প্রতিকার্য (সাধ্য রোগ), ক্ষমতা বা শক্তি (যত সাধ ছিল সাধ্য ছিল না, তবু বহিয়াছি কঠিন কামনা- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; ঝড়ের বাপের সাধ্য কতদূর তাহা নিশ্চয় বলা কঠিন, কিন্তু ঝড়ের সাধ্য যে কী তাহা কমলার অগোচর নাই- নৌকাডুবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; এ কথা যে জানে, তার সাধ্য নেই আজ তোমার মুখের কথা কয়টি শুনে হাসে- চরিত্রহীন, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; ত্রয়োদশ বৎসরের মধ্যে যে লেখাপড়া শিখা যাইতে পারে, তাহাই তাহাদের সাধ্য- সাম্য, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; কল্যাণী অকস্মাৎ পুরুষস্পর্শে রোমাঞ্চিত, ভীত, বিস্মিত, অশ্রুবিপ্লুত হইল, এমন সাধ্য নাই যে পলায়ন করে, ভীতিবিহ্বলা হইয়া গিয়াছিল- আনন্দমঠ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)।


অন্যদিকে বাংলায় সাধ্য মানে সম্পাদনের শক্তি (কাজটি করতে আমার সাধ্যে কুলোবে না)। আবার বাংলায় সাধ্য-সাধনা ‘অনুনয় বিনয়’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। মূলগতভাবে সংস্কৃত সাধ্য শব্দের মানে ‘সাধনযোগ্য’। কিন্তু বাংলায় ঢোকার পর শব্দটি তার মূল অর্থ ধরে রাখতে পারেনি। বাংলায় সাধ্য মানে ‘সামর্থ্য’। সাধ্যি বানানভেদ।


লেখাটি লেখকের ব্লগ থেকে নেয়া


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com