শিরোনাম
একেবারেই অন্যরকম অভিজ্ঞতা
প্রকাশ : ৩০ জুন ২০১৭, ২০:০২
একেবারেই অন্যরকম অভিজ্ঞতা
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

আমি তখন নানার বাড়িতে থেকে একটি ক্রিশ্চিয়ান মিশনারি স্কুলে ক্লাস থ্রিতে পড়ি। সেসময় আমি একবার ভিক্ষা করেছিলাম। সেই অভিজ্ঞতার কথা বলি।


আমি আমার নানীর (আমার নানার ছোটভায়ের বৌ) সাথে নানীর বাপের বাড়ি বেড়াতে গেছি। আমি এর আগে কখনও মা-কে ছাড়া অচেনা কোথাও বেড়াতে যাইনি। নানী তিন দিনের জন্য এসেছেন তাঁর চাচাতো ভায়ের বিয়ে উপলক্ষে। সাথে আমি। বাড়িভর্তি লোক। অনেক দূর থেকে আত্মীয়রা এসেছেন, আসছেন। বিয়েবাড়িতে নাচ-গান হচ্ছে। কিন্তু আমার ভালো লাগছিল না। আমি মা-কে মিস করতে লাগলাম। ফিরে যাবার জন্য ছটফট করতে লাগলাম। রাতে শুয়ে অন্ধকারে ফুঁপিয়ে কাঁদলামও। নানী পড়ে গেলেন বিপদে। বিয়ে শেষ না হলে তিনি ফিরবেন না, আবার কোনো লোকও পাওয়া যাচ্ছিল না, যার সাথে আমাকে ফেরত পাঠাবেন।


পরদিন বিকেলবেলা ভিক্ষা করতে এলো নানার গ্রামের দুই হিন্দু বিধবা। এঁদের আমি 'দীদা' ডাকি। আমি দুই দীদাকে দেখে মহাখুশি। নানীকে বললাম, "নানী, আমি দীদাদের সাথে চলে যাই?" নানী আপত্তি করলেন না। এক দীদার বাড়ি নানার বাড়ির তিনটা বাড়ি পর। সুতরাং সমস্যা নেই।


আমি দীদাদের সাথে রওনা দিলাম হেঁটে। দু'টা গ্রাম পর আমার নানার গ্রাম। দীদারা ভিক্ষা করতে-করতে ফিরছেন। আমি তাদের পেছন-পেছন যাচ্ছি। যে বাড়িতেই যাই, সেই বাড়ির লোকজনই হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। এত সুন্দর নাদুস নুদুস বাচ্চাটা ভিক্ষুক! সবাই দীদাকে একই প্রশ্ন করে, "এটা কে? কেন ভিক্ষা করছে?"


এক বাড়ির গৃহিণী শুকানো কুমড়ো বড়ি পাতিলে তুলছিলেন। "কত্তা মা, চারটে ভিক্কে পাই" - হাঁক শুনে ঘুরে তাকালেন। দীদারা তাঁর পরিচিত। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে দীদাদের প্রশ্ন করলেন, "বৈরাগীর বুড়ি, এ মেয়ে কে?" দীদা বললেন, "আমার গ্রামের পরধানের নাতনী"। আমার নানার পদবী ''প্রধান''। আশপাশের কয়েক গ্রামে তিনি বেশ পরিচিত মানুষ। আমি কেন তাদের সাথে, দীদা সেই ফিরিস্তি দেবার পর ক'টা বড়ি চাইলেন। মহিলা দুই দীদাকেই চালসহ গোটা বিশেক বড়ি দিলেন।


এক বাড়িতে সুন্দরী এক নতুন বৌ, মাথায় বড় ঘোমটা দেয়া, শুকনা বরই ঝাঁকাতে তুলছে। আমার বরই খুবই পছন্দ। তাও আবার শুকনো লাল লাল বরই। বৌটি আমার মনের কথা বুঝতে পেরে আমার দু'হাত ভরে বরই দিলেন জোর করে। আমি সেই বরই খেতে খেতে দীদাদের পিছে পিছে আবার হাঁটতে লাগলাম।


লাঠি হাতে এক বুড়ো দাদু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, "এই মেয়ে, তুমি কোন ক্লাসে পড়?" আমি মিশন স্কুলে থ্রিতে পড়ি শুনে বললেন, "বল, রহিমেরা চার ভাই - এর ইংরেজী কি হবে?" আমার উত্তর শুনে উনি ভীষণ খুশি হলেন। উনি বোধহয় ভেবেছিলেন, আমি পারব না। দাদু ওনার মেয়েকে ডেকে কি যেন বললেন। একটু পরে মেয়ে দু'টো বড় বড় মুড়ির মোয়া এনে আমার হাতে দিলেন।


এক বাড়ির উঠানভর্তি মরিচ শুকাতে দেয়া আছে। দীদা সেখান থেকে মরিচ চেয়ে নিলেন। আরেক বাড়ির উঠানে ক্ষেত থেকে তুলে আনা পটল আর বেগুনের ছড়াছড়ি। দীদা সেসবও চেয়ে নিলেন। এভাবে প্রায় সব বাড়ি থেকেই পেঁয়াজ, রসুন, আলু,... চেয়ে চেয়ে নিলেন ভিক্ষার চালসহ। আমি দেখলাম, কেউ 'না' বলছে না, বিরক্তও হচ্ছে না।


এ ঘটনাটা আমি মাঝে মাঝেই মনে করি। এই ঘটনাটি থেকে আমার মনে কিছু প্রশ্ন জাগে। যথা -


- আমাদের সময় গ্রামের সবাই ছিল আপন। একটা পরিবারের মত। ভিক্ষুককেও আমরা দীদা ডাকতাম। এখনো ডাকি। এখনকার ছেলেমেয়েরা কি ডাকে? গ্রামের মানুষের মধ্যে এমন ভাব কি এখনো আছে?


- গ্রামে ভিক্ষুকদেরও সম্মান ছিল। কেউ তাদের ফেরাতো না। খারাপ ব্যবহার করতো না। এখনও কি তেমন করে?


- আমাদের সময়ে গ্রামে হিন্দু- মুসলিম সবার মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। সেই সৌহার্দ্যপূর্ণ ও বিশ্বস্ততার সম্পর্ক কি এখনও আছে?


- শুধু চাল নয়, প্রায় সব জিনিসই ভিক্ষুকরা গ্রামের কৃষক পরিবারের লোকদের কাছ থেকে পেত। এখনও কি পায়?


আমার নানাবাড়ী জয়পুরহাট জেলার দোগাছি ইউনিয়নের ঘাশুরিয়া গ্রামে (পোস্ট অফিস দরগাতলা হাট)। এ গ্রামের ৬/৭ ঘর মুসলিম আর বাকি পুরো গ্রামের বাসিন্দারা হিন্দু। কিছু সাঁওতালও আছে। আমার নানা ছিলেন এ গ্রামের প্রধান। সারাজীবন উনি সালিশ-বিচার করেছেন, গ্রামের মানুষের নানা প্রয়োজনে পাশে থেকেছেন। ছোটবেলা থেকে দেখেছি, যখন পুরো গ্রামে মোটে ২/৩ টা টিউবওয়েল ছিল তখন নানার বাড়ির আশপাশের সবকটি হিন্দু বাড়ির লোকজন নানার কলের পানি খেত, নানার পুকুরে গোসল করত (এখনো করে), ষষ্ঠী পূজার ফল নিয়ে যেত নানার বাগান থেকে।


সবচেয়ে অবাক হতাম, গ্রামের পূজা-কীর্তনের সময় ঢাকঢোল বাজিয়ে গ্রামের নারী-পুরুষ উৎসব করতো, কিন্তু নানার উঠানে কখনো আসতো না। কি সুন্দর সহাবস্থান! গ্রামের প্রতিটা বিয়েতে নানার দাওয়াত থাকতো। নানা তাঁর পুকুরের বড় বড় কাতল মাছ তুলে দিতেন বিয়েতে রান্নার জন্য। নতুন বর-বৌ নিয়ে লোকজন আসতো নানার দোয়া নিতে। নানা নতুন বর-বৌকে দোয়া করতেন, নতুন বৌয়ের হাতে টাকা দিতেন।


নানার সবচেয়ে ভাল বন্ধু ছিলেন যতীন বৈরাগী দাদু। তিনি নানার সাথে বর্ষার দিনে একই ছাতার তলে আধাআধি ভিজতে ভিজতে হাসিমুখে গল্প করতে করতে হাট থেকে ফিরতেন।


ছোটবেলায় দাদু আমাকে মাছ ধরার খুতি বানিয়ে দিতেন। আখের জমির ভিতর দিয়ে যে নালা বয়ে গেছে, সেইখানে খুতি ফেলে রাখলে রাতে তাতে মাগুর আর টাকি মাছ পড়ত। কিডনি রোগে ভুগে দাদু মারা যাবার পর গ্রামের হিন্দুদের সাথে আমিও কেঁদেছি।


এখনো নানার বাড়ি গেলে গ্রামের লোকেরা আমাকে দেখে খুব খুশি হন, একান্ত আপনজনকে দেখলে লোকে যেমন হয়। কুশল বিনিময় করে। আমি অনেকের বাড়িতে যাই। আমার মনে আছে, আমার সন্তান হবে শুনে এক কাকীমা বলেছিলেন, "আশীর্বাদ করি, তোমার ছেলে হোক মা।" আমি অবাক হয়েছিলাম। আমার ছেলে হলেও ওনার কিছু যায়-আসে না, মেয়ে হলেও না। ওনার মেয়ের জন্য তিনি যে দোয়া করতেন, আমার জন্যও তাইই করেছেন। এরই নাম মানবতা। এখনো নানা কাজে নানার গ্রামের হিন্দুরা রাজশাহী এলে আমাদের বাসায় ওঠে। আম্মা পরম যত্নে তাদের দেখাশোনা করেন। দেখে আমার ভালো লাগে।


বাংলাদেশের গ্রামগুলো কি এখনও এমন আছে?


সম্ভব হলে আর একবার দীদাদের সাথে ভিক্ষা করতে বের হতাম। দেখে আসতাম, এখনকার মানুষের মানসিকতায় কী কী পরিবর্তন হয়েছে।


আল্পনা তালুকদারের ব্লগ থেকে


বিবার্তা/কাফী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com