শিরোনাম
এই ‘সরস্বতী’ আর সেই ‘সরস্বতী’
প্রকাশ : ১৯ জুন ২০১৭, ০৯:৪২
এই ‘সরস্বতী’ আর সেই ‘সরস্বতী’
জিয়াউদ্দিন সাইমুম
প্রিন্ট অ-অ+

বাংলা ভাষায় অনেক শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ আর প্রচলিত অর্থ এক রকম হয় না। সরস্বতী শব্দটি তারই প্রমাণ। কারণ শব্দটির ব্যুপত্তিগত অর্থ হচ্ছে ‘জলপূর্ণস্থান’। কিন্তু চলতি অর্থ বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী (গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করিবেন- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; রূপে হলে অপ্সরী আর নৃত্যগীতে কিন্নরী। শ্লোক রচনায় সরস্বতী ধী শ্রীমতী সুন্দরী- সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত; মা-সরস্বতী অনেক সময়ে তাঁহাদের প্রার্থনানুসারে বিদ্যা ফিরাইয়া লন, কিন্তু কড়ি ফিরাইয়া দেন না- আদিম আর্যনিবাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।


পঙ্কজ মানে ‘যা জলে জন্মায়’। কিন্তু জলে যা কিছু জন্মায়, তা কিন্তু পঙ্কজকে বোঝায় না। পঙ্কজ বলতে শুধু পদ্মফুলকে বোঝায়। সরস্বতী শব্দটির বেলায়ও কথাটি সত্য।


হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অভিধানে ‘সরস্বান’ ভুক্তিতে মনিয়ের-উইলিয়ামসের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন ‘ঋগ্বেদে অধিকাংশস্থলে ‘সরস্বতী’ শব্দ ‘সিন্ধুনদ’ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। কোন কোন স্থলে মধ্যদেশস্থ ‘দেবনদী’ অর্থেও ইহার প্রয়োগ আছে। পুষা ইন্দ্র অশ্ব্নি ও মরুদগণের সহিত দেবীরূপে ইহার উল্লেখ দেখা যায়। ব্রা‏হ্মণে সরস্বতী ‘বাক’রূপে এবং পরবর্ত্তীকালে বাক্যের ‘অধিষ্ঠাত্রী’ভাবে বর্ণিত হইয়াছে।’


বাংলা সাহিত্যে অনেকের লেখায় সরস্বতী প্রসঙ্গটি নানাভাবে ফুটে এসেছে (নিরবিলা সরস্বতী কূজনিল পাখী সমধুরতর স্বরে সে নিকুঞ্জ বনে- মাইকেল মধুসূদন দত্ত; পক্ষী হই যার হ্রদে হৈল জ্ঞান যুক্তি, সতত তাহার কণ্ঠে বৈসে সরস্বতী- আলাওল)।


তবে ভাষাতাত্ত্বিক ইতিহাসে সরস্বতী শুধু একটি শব্দ বা দেবীর নাম নয়, এটা গবেষণায় একটি আকর্ষণীয় উপাদানও বটে। কারণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিদ্যা দেবী হিসেবে সম্মানিতা হলেও বৈদিক সমাজে তিনি ছিলেন ধনদেবী।


‘সরঃ’ ইন্দো-ইরানী ভাষা গোত্রের শব্দ। সরঃ মানে জল। প্রাচীন ফারসি ভাষায় ‘সরঃ’ এর প্রতিশব্দ ‘হর’। সরঃ শব্দ থেকে সরোবর, সরসী (দীঘি), সরসিজ (পদ্ম), সরোজ (পদ্ম) ইত্যাদি শব্দ তৈরি হয়েছে।


আবার সরস্বান মানে নদ, এ শব্দের মূলেও রয়েছে সরঃ। কারণ যা সরঃ বা জল ধারণ করে তাই সরস্বান বা নদ।


ঋগ্বেদে সরস্বতী একটি পাহাড়ি নদী। বৈদিক ঋষিদের প্রার্থনা: ‘হে সরস্বতী তুমি আমাদের হীন করো না। অধিক জল দ্বারা আমাদের উৎপীড়িত করো না। তুমি আমাদের বন্ধুত্ব ও গৃহ স্বীকার কর। আমরা যেন তোমার নিকট হতে অপকৃষ্ট স্থানে গমন না করি’ [ঋগ্বেদ, ৬/৬১/১৪ অনুবাদ রমেশচন্দ্র দত্ত]


বৈদিক ঋষিরা সরস্বতীর কাছে আরো প্রার্থনা জানাচ্ছেন, ‘হে সরস্বতী, অন্ন দ্বারা সম্যকরূপে তৃপ্তি সাধন কর। আমাদের রক্ষা কর। ভোগযোগ্য সম্পদ দান কর।’


‘উদকবতী’ সরস্বতীর প্রতিশব্দ। উদক বা জল ধারণ করেন যিনি, তিনিই উদকবতী। ঋগ্বেদে ধনদেবী সরস্বতীকে রক্ষাকারিনী, আরোগ্যদায়িনী ইত্যাদি বলা হলেও তাকে বিদ্যাদেবী বলা হয়নি। সরস্বতী কিভাবে ধনদেবী থেকে বিদ্যা দেবী হলেন, তার নানা ব্যাখ্যা দিয়েছেন ভারততাত্ত্বিক পণ্ডিতরা। কিন্তু বোধগম্য ব্যাখ্যা এখনও মেলেনি। তবে রমেশচন্দ্র দত্তের ব্যাখ্যাটি আকর্ষণীয়। তিনি বলেছেন, Sarasvati, as her name signifies, is the goddess of the river of that name, which was considered holy because of the religious rites performed on its banks and the sacred hymns uttered there. By a natural development of ideas, she was considered the goddess of those hymns.


ধারণা করা হয়, ঋগ্বৈদিক নদী সরস্বতী প্রাচীনকালেই হারিয়ে যাবার কারণেই সরস্বতী দেবীর ভিন্নরূপে উপস্থাপিত হবার পথ খুলে গেছে। কিন্তু কেন বিদ্যাদেবী রূপে আবির্ভূত হলেন, সেটাই মৌলিক গবেষণার বিষয় হতে পারে।


হিন্দুশাস্ত্রে সরস্বতী বিদ্যাদেবী নামে আখ্যায়িত। পৌরাণিক আখ্যায়িকায় সরস্বতীর ষোড়শ মূর্তিকল্পিত। যেমন রোহিণী, প্রজ্ঞপ্তী, বজ্রশৃঙ্খলা, কুলিশঙ্কুশা, চক্রেশ্বরী, পুরুষদত্তা ভারতী, কালী, মহাকালী, গৌরী, গান্ধারী, সর্বাস্ত্রমহাজ্বালা, মানবী, বৈরাট্যা, অচ্ছুপ্তা, মানসী ও মহামানবী।


উল্লেখ্য, এককালে বঙ্গদেশে ছুটির পর ছাত্র-ছাত্রীরা সরস্বতী বন্দনা করতো এভাবে: ‘সরস্বতী ভগবতী মোরে দাও বর, চল ভাই পড়ে সবে মোরা যাই ঘর, ঝিকিমিকি ঝিকিরে সুবর্ণে চক, পাত-দোত নিয়ে চল জয় গুরুদেব।’


সরস্বতী শব্দের গঠন সংস্কৃত সরস্ + বৎ (বতুপ্) + ঈ।


লেখাটি লেখকের ব্লগ থেকে নেয়া


বিবার্তা/জিয়া


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com