শিরোনাম
সঙ্কীর্ণের বেলাভূমে এক সঙ্কোচ
প্রকাশ : ২৬ মে ২০১৭, ০৯:৪৫
সঙ্কীর্ণের বেলাভূমে এক সঙ্কোচ
জিয়াউদ্দিন সাইমুম
প্রিন্ট অ-অ+

সংস্কৃতে সঙ্কীর্ণ শব্দের নানা অর্থ রয়েছে এবং এসব অর্থে শব্দটি বাংলায় প্রচলিত নয়।


অমরকোষের টীকায় সঙ্কীর্ণ অর্থে ‘লোকজন কর্তৃক নিরন্তরব্যাপ্ত’ বলা হয়েছে। শব্দকল্পদ্রুমে তার সাক্ষ মেলে ‘নানা জাতি সম্মিলিত’। অর্থাৎ সঙ্কীর্ণ মানে সঙ্কুল, আকীর্ণ।


সংস্কৃতে সঙ্কীর্ণ শব্দের অন্যান্য অর্থের মধ্যে সংমিশ্রিত, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত, যে যুদ্ধে একই সময়ে নানা ধরনের অস্ত্র ব্যবহৃত হয় বা অনেকের সাথে যুদ্ধ হয়, অভিভূত, সঙ্কট, পরস্পর বিজাতীয় অন্যতম।


আবার সংস্কৃতে পুংলিঙ্গে সঙ্কীর্ণ অর্থ মিশ্রজাতি আর ক্লীবলিঙ্গে সংকট, কৃচ্ছ্র। সঙ্গীতে সঙ্কীর্ণ মানে মিশ্ররাগ।


V.S. Apte তাঁর ‘The Practical Sanskrit English Dictionary’-তে সঙ্কীর্ণ শব্দের অর্থে ‘মত্ত হাতি’ লিখেছেন।


কিন্তু বাংলায় সঙ্কীর্ণ অর্থ অপ্রশস্ত, অনুদার, ক্ষুদ্র (অনুদার হৃদয়), অল্প (চণ্ডীগড়ের সঙ্কীর্ণ গ্রাম্যপথের পরে সন্ধ্যার ধূসর ছায়া নামিয়া আসিতেছে- ষোড়শী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; যেমন গর্ত হইতে পিপীলিকা বাহির হইবার সময়ে, বালকে একটি একটি করিয়া টিপিয়া মারে, তেমনই রাজপুতেরা মোগলদিগকে সঙ্কীর্ণ পথে টিপিয়া মারিতে লাগিল- রাজসিংহ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; আমাদের দৃষ্টিশক্তির প্রসর সঙ্কীর্ণ তথাপি সমুদয় সৌর জগতের একমাত্র উদ্দীপনকারী সূর্যই কি আমাদিগকে আলোক বিতরণের জন্য নাই?- ঔপনিষদ ব্রহ্ম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর), সরু (যাহা প্রতিদিনের, যাহা চারিদিকের, যাহা হাতের কাছে আছে, তাহা আমাদের কাছে বিস্বাদ হইয়া আসে, ইহাতে সংকীর্ণ সীমার মধ্যে আমাদের অনুভবশক্তির আতিশয্য ঘটাইয়া আর সর্বত্র তাহার জড়ত্ব উৎপাদন করা হয়- আধুনিক সাহিত্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর), শুষ্কদেহ (বৃক্ষ (যেন) বিশীর্ণ সঙ্কীর্ণ ক্রমে অন্তঃসার হারা- হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘চারিত্রপূজা’ গ্রন্থে উদারতাহীন অর্থে সঙ্কীর্ণ শব্দের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন (দয়ার মধ্যে এই জিদ থাকাতে তাহা সঙ্কীর্ণ ও স্বল্পফলপ্রসূ হইয়া বিশীর্ণ হইয়া যায়)।


সংকীর্ণ বানানভেদ। সঙ্কীর্ণ শব্দের গঠন হচ্ছে সংস্কৃত সম্ + (কৃ + ত (ক্ত)।


অন্যদিকে সংস্কৃতে সঙ্কোচ অর্থ কুটিলীভাব, আকুঞ্চন, সংক্ষেপ, অপ্রসার, ভঙ্গ, ভাঁজ, জড়ীভাব। শব্দকল্পদ্রুমে সঙ্কোচ অর্থে বলা হয়েছে ‘বহুবিষয়ক বাক্যার্থাদির অল্প বিষয়ে স্থাপন।’


কিন্তু বাংলায় সঙ্কোচ শব্দটি দিয়ে লজ্জা, কুণ্ঠা বোঝায়। এছাড়া বাংলায় সঙ্কোচ বলতে অন্যের সম্মান হানিতে লজ্জাবোধ (পাদ্য অর্ঘ্য রাখিয়াছে দিব্য জলাধার। আমার সঙ্কোচ কিছু আছয়ে ইহার- কাশীদাসী মহাভারত), অন্যায়হেতু কুণ্ঠা (বেঢ়িল হস্তিনাপুরী সঙ্কোচ না করে- কাশীদাসী মহাভারত), অভাব, নূন্যতা (যেই মাত্র সম্বল সঙ্কোচ হয় ঘরে। সেই এই মত সোনা আনে বারে বারে- চৈতন্যভাগবত)।


গমনে ক্লেশ অর্থেও বাংলায় বিশেষ্য পদ হিসেবে সঙ্কোচ শব্দের ব্যবহার ছিল (পথে পঙ্ক সঙ্কোচ পৃথিবী পয়োময়- শিবায়ন)।


আবার বাংলায় বিশেষণ পদ হিসেবেও সঙ্কোচ শব্দের ব্যবহার আছে। যেমন কুণ্ঠিত (সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান, সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ, মুক্ত করো ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়- রবীন্দ্রসংগীত; কিন্তু ডাক যখন সত্যই পড়িল, তখন বুঝিলাম, বিস্ময় এবং সঙ্কোচ আমার যত বড়ই হোক, এ আহ্বান শিরোধার্য করিতে লেশমাত্র ইতস্ততঃ করা চলিবে না- শ্রীকান্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; পতিব্রতা যুবতীর পক্ষে রাত্রিকালে নির্জনে অপরিচিত পুরুষের সহিত সাক্ষাৎ যে অবিধেয়, ইহা ভাবিয়া তাঁহার মনে সঙ্কোচ জন্মে নাই- কপালকুণ্ডলা, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়), অপ্রতিভ (গালি দেয় ব্রাহ্মণ যতেক মুখে আইসে। সঙ্কোচ হইয়া পার্থ ব্রাহ্মণে আশ্বাসে- কাশীদাসী মহাভারত), রোষহীন, শান্ত, নরম (গোবিন্দেরে পুছে ইহা করাইলে কোন জন? জগদানন্দের নাম শুনি সঙ্কোচ হইল মন- চৈতন্যচরিতামৃত)।


সংকোচ বানানভেদ। সঙ্কোচ শব্দের গঠন হচ্ছে সংস্কৃত সম্ + কুচ্ + অ।


● লেখাটি লেখকের ব্লগ থেকে নেয়া


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com