শিরোনাম
‘উমা’ শব্দের মূল নিয়ে কাজিয়া
প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০১৬, ১৮:২২
‘উমা’ শব্দের মূল নিয়ে কাজিয়া
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

বাংলা ‘আম্মা’ বা ‘আম্মি’ শব্দটি আরবি ‘উম্ম’ শব্দেরই বিকৃত রূপ। আরবি ‘উম্ম’ সেমেটিক ভাষার শব্দ। প্রাচীন ব্যাবিলনবাসীও মাকে ‘উম্ম’ বলত। আকাদীয়রা বলত ‘উম্মি।’ প্রাচীন সিন্ধু সমাজেও ‘উম্ম’ শব্দটি চালু ছিল বলে ধারণা করা হয়। এ ধারণার ভিত্তি হচ্ছে ব্যাবিলনের সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার বাণিজ্যিক ও ধর্মীয় সম্পর্ক থাকা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। আর সম্পর্ক থাকলে সিন্ধু সমাজে সেমেটিক ভাষার প্রভাব পড়াটাও বিচিত্র কিছু নয়। S.K. Diksit তার Mother Goddess গ্রন্থে দাবি করেছেন, উমা নামটি সেমেটিক ‘উম্ম’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে।


অথচ চতুর্বেদের কোথাও উমা দেবীর দেখা মিলে না। তাই উমা শব্দের মূল নিয়ে এতো টানাটানি চলছে। উমা দেবীর আবির্ভাবের প্রথম প্রত্নপ্রমাণ মেলে হবিস্কের একটি মুদ্রায়। দেবী মূর্তি অঙ্কিত মুদ্রাটিতে তার নাম লেখা হয়েছে ‘ওম্মো’। এখান থেকে ধারণা করা হয়, কুষাণ যুগেও উমা নামের প্রচলন হয়নি। পরে সংস্কৃত ভাষার সংস্কারের প্রভাবে অন্ত্যব্যঞ্জন ধ্বনি হ্রাস করে ‘ওম্মো’ শব্দটির ‘উমা’ রূপ দেয়া হয়। পরে কাব্যে-নাটকে-মণ্ডপে দেবীর ‘উমা’ নামটি চালু হয়ে যায়।


কিন্তু ‘উমা’ নামের প্রকৃতি-প্রত্যয় নিয়ে গোল বাধায় অভিধান প্রণেতারা শব্দটির ব্যুৎপত্তি এড়িয়ে গেলেন। শাস্ত্রকাররা বসে রইলেন না। তারা উমা শব্দের হরেক বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা হাজির করলেন। ফলে এসব মনগড়া ব্যাখ্যায় কারো সঙ্গে কারো মতের মিল রইল না। (দেখুন, শশিভূষণ দাশগুপ্তের ‘ভারতের শক্তি সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য’)।


তাদের কেউ উ-কারে শিব এবং ম-কারে শ্রী অর্থ আরোপ করে উমার শিবশ্রী নাম দাঁড় করালেন। কেউবা আরও সহজ সরল ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন, জন্মকালে দেবী ‘উমা উমা’ শব্দ করেছিলেন বলে তার নাম হয়েছে উমা।


উমা শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয়ে আরেক ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন মহাকবি কালিদাস। শিবের পত্নী কামনায় দেবীর কৃচ্ছ সাধনের সঙ্গে তিনি উমা নামের মনগড়া ব্যাখ্যা দাঁড় করালেন। শিবকে পেতে কঠোর তপস্যা দেখে উমার মা মেনকা বললেন, ‘উমা’ মানে ‘উহে আর নয়।’ এ অনুরোধ বাক্য থেকেই নাকি দেবী ‘উমা’ নাম পেয়েছেন। পুরাণসমূহেও উমা নামের পরস্পর সাংঘর্ষিক ব্যুৎপত্তির কথা লেখা আছে।


উমা নামের প্রথম দেখা মেলে কেনোপনিষদে। ধারণা করা হয়, উপনিষদটি কুষাণ বংশ ও কালিদাসের মধ্যবর্তী সময়ে রচিত। বৈদিক যুগের প্রধান দেবতা ইন্দ্রকে ছাড়িয়ে পরম-ব্রহ্মের প্রাধান্য সূচনার যুগ এটা। আর উমার আবির্ভাব ঘটে ব্রহ্মের ছায়ারূপে। কেনোপনিষদে উমাকে তাই ব্রহ্মবিদ্যারূপে অভিহিত করা হয়েছে।


কেনোপষিনদে উমা দেবীর আবির্ভাব ক্ষণটি বেশ তাৎপর্যময়। কারণ দেবী সরাসরি আবির্ভূত হলেন ইন্দ্রের সামনে। আর সর্বালঙ্কার ভূষিতা সুশোভনা নারীরূপে দেবীকে দেখে স্বয়ং ইন্দ্র তাকে ভক্তিপূর্ণ হৃদয়ে শ্রদ্ধা জানান। এর মাধ্যমে ঋগ্বৈদিক আর্যদের প্রধান দেবতা ইন্দ্রের ভক্তি আদায় করে শুরুতেই উমাদেবী তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন। লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার হল কেনোপষিদের পরই উমা দেবীকে কালিদাসের কুমারসম্ভবে দেখা গেল ভিন্ন আবহে। এখানে তিনি শিবের ঘরনী হয়েই সন্তুষ্ট। যে দেবী কেনোপনিষদে ইন্দ্রকে অভিভূত করেছেন, তিনিই কিনা শিবের কাছে ম্লান হয়ে গেলেন। তপস্যাকালে গাছের পাতা পর্যন্ত না খেয়ে হলেন অপর্ণা। অথচ শিবের গরজ নেই। শেষে দেবীকে বিয়ে করে যেন জীবন ধন্য করে দিলেন। সবচেয়ে বড় কথা ইন্দ্র গেল, ব্রহ্ম গেল, উমাও গেল। শুরু হল শিবের প্রাধান্য (তোর ঐশ্বর্য যা কিছু মা, সে ভক্তগণে বিলিয়ে উমা, ভিখারী এই সন্তানে দিস্। মাতৃনামের ভিক্ষাঝুলি; কৈলাশ হতে গিরি রানীর মা দুলালী কন্যা আয় আর উমা আনন্দময়ী- কাজী নজরুল ইসলাম; উমার মুখ চাঁদের চূড়া বুড়ার দাড়ী শনের নুড়া- ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর; আগম, পুরান, বেদ, পঞ্চতন্ত্রকথা পঞ্চমুখে, পঞ্চমুখ কহেন উমারে- মধুসূদন দত্ত)।


ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর ‘গোত্রভিদ্ ইন্দ্র’ প্রবন্ধে লিখেছেন, কালিদাস কুমারসম্ভবে উমা শব্দের ব্যাখ্যায় বলিতেছেন-


উপেতি মাত্রা তপসো নিষিদ্ধা পশ্চা দুমাখ্যাং সুমুখী জগাম।


উ(ওগো) মা (না) অর্থাৎ ওগো আর তপস্যা করিও না। মাতা কর্ত্তৃক এই প্রকারে তপস্যা হইতে নিষিদ্ধ হইয়া পরে সুমুখী উমা নাম পাইলেন। কালিদাস উমা নামের যে কারণ দিয়াছেন তাহা ‘কালকাটা’ হইতে কলিকাতা নামে উৎপত্তির ন্যায়। কালিদাস অপ্রকৃত ব্যুৎপত্তিতে এই পৌরাণিক আখ্যানের সৃষ্টি করিয়াছেন মাত্র।’


জিয়াউদ্দিন সাইমুমের ব্লগ থেকে


বিবার্তা/জিয়া


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com