শিরোনাম
পিঠে বোঝাওয়ালা বর্ণটি
প্রকাশ : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০৮:৫৫
পিঠে বোঝাওয়ালা বর্ণটি
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

অদ্ভুত চেহারার নিরীহ বর্ণ ‘ঞ’ উচ্চারণেও অদ্ভুত। কেউ বলেন ‘নিয়ো’, কেউবা ‘ইঁয়োঁ’। চ বর্গের প্রান্তে তার অবস্থান, তবে এটার একক ও খাঁটি উচ্চারণ কোথাও নেই- বাংলাদেশ বলুন আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গেই বলুন।


আবার পিঠে বোঝাওয়ালা এ বর্ণটি এখন আর একা একা নড়তে পারে না। তবে অন্য বর্ণের ঘাড়ে চাপলে দিব্যি চলে। নিদেনপক্ষে কোলে চেপে বসে। যেমন ঞ্চ ঞ্ছ ঞ্জ ঞ্ঝ জ্ঞ।


অবশ্য ঞ এর এ খঞ্জ দশা সব সময় ছিল না। এক সময় ছিল তার বেশ দাপট। প্রাচীন বাংলার ন স্থানে, ম স্থানে, চন্দ্রবিন্দু স্থানে, অনুনাসিকের পরে, অনুনাসিকের আগে এবং সানুনাসিকের উচ্চারণ হেতু ঞ বর্ণের প্রচলন ছিল।


মণীন্দ্রকুমার ঘোষ তাঁর ‘বাংলা বানান’ গ্রন্থে পাঁচটি স্থানে ঞ বর্ণের ব্যবহার তুলে ধরেছেন।


যেমন ন স্থানে: ঞিঅম (নিয়ম), ঞিস্তারিতে (নিস্তারিতে), ঞিশ্চিন্ত (নিশ্চিন্ত), ঞির্বিঘ্নে (নির্বিঘ্নে)।


ম স্থানে: তুঞি (তুমি), গোসাঞি (গোস্বামী)


চন্দ্রবিন্দু স্থানে: ঞিহার (ইঁহার), ঞেহারে (এঁহারে)।


অনুনাসিকের পরে: নাঞি (নাহি), নাঞিক (নাহিক), শুনিঞা (শুনিয়া) আনিঞা (আনিয়া), প্রণামিঞা (প্রণামিয়া), অমিঞা (অমিয়া), জন্মিঞা (জন্মিয়া)।


অনুনাসিকের আগে: কঞোন (কওন> কোন), মন্দাঞিনি (মন্দাকিনী)। সানুনাসিকের উচ্চারণ হেতু: ধাঞ্চা (ধাইয়াঁ), লঞা (লইয়াঁ), দিঞা (দিয়াঁ), গিঞা (গিয়াঁ), যাচিঞা (যাচিয়াঁ), শিখাঞা (শিখাইয়াঁ)।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বাংলা ভাষা পরিচয়’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘এই ঞ অন্য ব্যঞ্জনবর্ণকে আঁকড়িয়ে টিকে থাকে, একক নিজের জোরে কোথাও ঠাঁই পায় না।’


এটা ভুলে গেলে চলবে না, চ-বর্গের পঞ্চম বর্ণ ঞ কোন নির্দিষ্ট ধ্বনির প্রতীক নয়। এক সময় হাতেগোনা কয়েকটি শব্দেই ঞ-বর্ণের ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানে চ, ছ, জ, এবং ঝ এর আগে যুক্তবর্ণ হিসেবে ঞ এর ব্যবহার চোখে পড়ে। স্বতন্ত্র বর্ণ হিসেবে এর ব্যবহার আর চোখে পড়ে না। শুধু এখনো কেউ কেউ পদবি হিসেবে ‘মিঞা’, ‘ভূঁঞা’ বানান দুটি ব্যবহার করেন।


চ-বর্গীয় এই চারটি বর্ণের সঙ্গে ‘ঞ’ সংযুক্ত হলে উচ্চারণ হয় ‘ন’ এর মত। যেমন মঞ্চ> মন্চো, বাঞ্ছা> বান্ছা, ঝঞ্ঝা> ঝন্ঝা।


আবার চ ও ছ এর পরে যুক্ত হয়ে ঞ বিশেষ ধরনের উচ্চারণ সৃষ্টি করে। চ এর পরে ঞ এর যুক্তবর্ণ খুবই কম। যেমন যাচ্ঞা। এই শব্দটির সঠিক উচ্চারণ নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানীরা একমত হতে পারেননি। কারও মতে ‘যাচ্না’, কারও মতে ‘জাচিয়াঁ’। আবার কারো মতে ‘যাচাঁ’।


অন্যদিকে ‘জ’ এর সাথে ‘ঞ’ বসলে দুই ধরনের উচ্চারণ হয়। যেমন জ্ঞান> গ্যাঁন, জ্ঞাতি> গ্যাঁতি। কিন্তু শব্দের মাঝে অথবা শেষে বসলে উচ্চারণ দাঁড়ায় ‘গগ্ঁ’। যেমন বিজ্ঞান> বিগ্গাঁন, প্রজ্ঞা> প্রোগ্গাঁ।


ভাষাবিদ মুহম্মদ আবদুল হাই তাঁর ‘বাংলা লিপি ও বানান সমস্যা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘এ হরফটিকে আমরা ‘ইঁয়োঁ’ নামে অভিহিত করি। কিন্তু এটা স্বতন্ত্র কোনো ধ্বনির প্রতীক নয়। মিঞা প্রভৃতি শব্দে ‘ঞ’ অনুনাসিক স্বরধ্বনি ‘আঁ’র দ্যোতক, ‘যাচঞা’ শব্দে ’না’র দ্যোতক, ‘জ্ঞান’ শব্দে ‘্য’র দ্যোতক এবং ‘বিজ্ঞ’ শব্দে ‘গঁগো’র দ্যোতক, আর ব্যঞ্ছনা, লাঞ্ছনা প্রভৃতি শব্দে ‘ন’র দ্যোতক। এক এক জায়গায় ঞ হরফটির এ এক রকম উচ্চারণ দেখতে পাই বলে ধ্বনি অনুসারে প্রতিনিপিকরণ দেখতে গেলে ঞ কোথায়ও টেকে না।’


প্রাচীন বাংলায় ঞ নানা ধরনের বিভক্তি হিসেবে শব্দে ব্যবহৃত হতো। যেমন মাঞঁ (মা), তোঞ (তুমি), রতীঞ (রতি-হেতু), সুরতীঞ (সুরত দ্বারা), যুগতীঞ (যুক্তিতে), রাহুঞ (রাহুতে), এড়িঞা (এড়িয়া), ভাবিঞা (ভাবিয়া), গিঞা (গিয়া), করিঞা (করিয়া), তথাঞি (তথাহি), ঞিহার (ইহার), যাঞোঁ (যাই)।


ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যে ঞ বর্ণ অর্থে ঞকার লিখেছেন (ঞকার ঘর্ঘর ধ্বনি)। আর জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তাঁর অভিধানে বর্ণটি সম্পর্কে লিখেছেন ‘তালু ইহার উচ্চারণ স্থান। অন্য বর্ণের সহিত যুক্ত হইলে ইহার উচ্চারণ তালু ও নাসিকার সাহায্যে অনেকটা ‘ঙ্য’র মত হয়। কিন্তু চ-বর্গেও অন্য চারিবর্ণ যুক্ত হইলে ন্-বৎ হয়= সঞ্চয়। আবার প্রাচীন বাংলায় অনুনাসিক উচ্চারণ বা চন্দ্রবিন্দু স্থলে এর ভূরি ভূরি ব্যবহার ছিল। ‘রাধাঞে’ (= রাধাঞঁ= রাধায়= রাধাকে)- শ্রীকৃষ্ণকীর্তন।’


জিয়াউদ্দিন সাইমুমের ব্লগ থেকে


বিবার্তা/জিয়া


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com