শিরোনাম
বেকারমুক্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চান নোমান
প্রকাশ : ০৮ মে ২০১৭, ১৭:৩৪
বেকারমুক্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চান নোমান
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

একজন সফল ফ্রিল্যান্সার আহসান উদ্দিন নোমান। ২০১৫ সালে ‘বেসিস আউটসোর্সিং অ্যাওয়ার্ড ২০১৫’ পেয়েছেন তিনি। বর্তমান বিশ্বের মার্কেটপ্লেসে সফলভাবে আউটসোর্সিং কাজ করছেন। একা কাজ করে বৈদাশিক মুদ্রা আয় করার সময় পড়েন নানান কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। তৈরি করেন ‘কুইক টিম’ নামের একটি সেবামূলক আউটসোর্সিং সংগঠন। টিমটি ২০১৬ সালে ডিভিশনাল ক্যাটেগরিতে রংপুর থেকে বেস্ট ফ্রিল্যান্সার অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়।


বর্তমানে নোমান তার টিম মিলে প্রতি ৬ মাসে ১০০০ জন বেকার তরুণ-তরুণীদেরকে বিনামূল্যে বিভিন্ন বিষয়ের উপর ফ্রিল্যান্সিং এবং আউটসোর্সিং শিখিয়ে তাদেরকে ঘরে বসে সাবলম্বি করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছেন।


বিবার্তা২৪ডটনেটকে দেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে আহসান উদ্দিন নোমান জানালেন তার ফ্রিল্যান্সার জীবনের সফলতার পেছনের গল্প। জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ওঠে আসা ফ্রিল্যান্সার নোমানের জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের গল্প বিবার্তার পাঠকদের জানাচ্ছেন উজ্জ্বল এ গমেজ।


ময়মনসিংহের নেত্রকোনা জেলার হাপানিয়া গ্রামে জন্ম আহসান উদ্দিন নোমানের। বাবার চাকরির সুবাদে স্ব-পরিবার ১৯৯৮ সালে লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধায় চলে অসেন। এখানেই তার বেড়ে ওঠা।


ছোটবেলায় পারিবারিক স্মৃতি বিষয়ে নোমান বলেন, সত্যি বলতে কী ছোটবেলায় অসম্ভব দুষ্টু ছিলাম আমি। দিন শেষে ঘরে ফিরলে সন্ধ্যায় বসে যেতো বিচার বিভাগ। সারাদিনের যত অন্যায়, অপকর্মের বিচার করা হতো। এই বিভাগের বিচারক ছিলেন মা। বিচারের রায়ে চড়-থাপ্পড় থেকে শুরু করে বেতের বারি পর্যন্ত বরাদ্দ থাকতো। কিন্তু কি আর করার বিচারের রায় তো মেনে নিতেই হবে। ছোটবেলায় তাই বাবার চেয়ে বেশি ভয় পেতাম মাকে।



এই দূরন্ত নোমানের শৈশবে ইচ্ছে ছিলো বিজ্ঞান বিভাগে লেখাপড়া করে বড় হয়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। অন্যদিকে তাকে নিয়ে বাবা-মায়ের দুইজনেরই স্বপ্ন ছিলো ভিন্ন। চাকুরে বাবার স্বপ্ন, আমার ছেলে মাদ্রাসায় পড়বে এবং মাদ্রাসা থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করবে। মায়ের স্বপ্ন ছিলো ছেলেকে ইংরেজিতে লেখাপড়া করিয়ে দেশের সেরা কলেজ থেকে উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করানো।


নোমান মানবিক বিভাগে মাদ্রাসা থেকে দাখিল, আলিম পড়ার পর মাদ্রাসায় ফাজিলসহ (ডিগ্রি সমমান) কামিল (মাসটার্স সমমান) পড়ার পাশাপাশি রংপুর কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ইংরেজি বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।


নোমানের ভাষায়, আলহামদুলিল্লাহ, আমি বাবা-মা দু’জনেরই স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি। সেই সাথে ফ্রিল্যান্সার হয়ে কম্পিউটারের উপর কাজ করে নিজের স্বপ্নটা পূরণ করার চেষ্টাও প্রতি দিন একটু একটু করে যাচ্ছি।


বিজ্ঞান বিভাগে না পড়েও আজকে নোমান কম্পিউটার রিলেটেড কাজ করে ফ্রিল্যান্সার হয়েছেন। এই জন্যই শৈশবের ইচ্ছেটাকে কিছুটা হলেও পূরণ করতে পেরেছেন বলে মনে করেন নোমান।


প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষ করার পরও নোমান এখন খুব মিস করেন ছাত্রজীবনকে। তিনি বলেন, ছাত্রজীবন একটি অসাধারণ জীবন। পড়াশুনার জীবনটা অন্য সবার মতো আমারও ছিলো ভীষণ ভাল। সময় পেলে এখনও মেসে চলে যাই বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতে।



ফ্রিল্যান্সিংয়ের শুরুতে চ্যালেঞ্জের বিষয়ে নোমান জানালেন, ২০০৯ সালের দিকে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করি। মোটামুটি ভালই চলছিল ফ্রিল্যান্সিং কাজ। নানান সমস্যা তো ছিলই। তবুও চালিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একদিন আমেরিকান একজন ক্লাইয়েন্ট আমাকে একটি বড় ধরনের কাজের প্রজেক্টের অফার দেন, যার বাজেট ছিলো বাংলাদেশী টাকায় প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকা। কাজটির মেয়াদ ছিলো মাত্র ছয় মাস। কাজটি আমার একার পক্ষে করা সম্ভব না। এখন কী করি? বাংলাদেশের অনেক কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করেও কোন সহযোগিতা পাইনি।


ক্লায়েন্টকে দেয়া কাজের সুন্দর শ্যাম্পল তার জন্য ১ মাস অপেক্ষা করেছিলো। তার পরেও নোমান ক্লায়েন্টকে সহযোগিতা করতে পারেননি। তিনি বলেন, তাই মন খারাপ করে একদিন মাঠে বসেছিলাম। বসে বসে ভাবছিলাম কিভাবে আমার ক্লায়েন্টকে সহযোগিতা করা যায়। ঠিক তখনই মাথায় একটা টিম বানানোর বুদ্ধি এলো। দেরি না করে টিমের জন্য ঝটপট একটা নাম ঠিক করে ফেললাম। টিমের নাম দিলাম ‘কুইক টিম’। নামটি এজন্যই রাখলাম যেন ক্লায়েন্ট দেখেই বুঝতে পারে যে আমরা খুব দ্রুত সার্ভিস দিতে পারি।


এই টিম বানাতে তার সময় চলে যায় প্রায় ৬ মাস। ততখন নোমানের বায়ার আর তার জন্য অপেক্ষা করেনি। সেদিন নোমান বুঝতে পারলেন যে, এমন সমস্যায় নতুন অনেকেই পড়ছেন। তাই নিজে ফ্রিল্যান্সিং করার পাশাপাশি অন্যকে শেখানোর প্রতিজ্ঞা করেন।


বর্তমানে অনেক ফ্রিল্যান্সারই অবহেলিত, অসচ্ছল। সঠিক পরামর্শের অভাবে তারা কাজ জেনেও কাজ করতে পারছেন না। এমন ফ্রিল্যান্সারদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কাজে লাগিয়ে আর্থিকভাবে এবং সামাজিকভাবে দাঁড় করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন এই ফ্রিল্যান্সার।


আলাপ প্রসঙ্গে জানা গেল, ‘কুইক টিম’ অধীনে নোমান বর্তমানে প্রতি ৬ মাসে ১০০০ বেকার তরুণ-তরুণীকে বিনামূল্যে ফ্রিল্যান্সিং, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ওয়েব ডিজাইন এবং ইউটিউব মার্কেটিংয়ের কাজ শেখাচ্ছেন। আগামী জুন থেকে আরো ১০০০ জনকে ফ্রি প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থাও ইতোমধ্যেই করা হয়ে গেছে। নিজে থেকে মানুষের উপকার এবং শেখাতে পেরে অনেক আনন্দ পান এই ফ্রিল্যান্সার।



২০১২ সালে কয়েকজনকে নিয়ে যে টিমের কাজ শুরু করেন বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ২ হাজারেরও বেশি। নোমানের সাথে ৫০০ জন সদস্য সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। আজকে এই টিমের মাধ্যমে তিনি বড় বড় কোম্পানির কাজ খুব সহজেই ক্লায়েন্টকে ডেলিভারি দিতে পারছেন।


কুইক টিমের কার্যক্রমগুলো টিমের মধ্যে থেকে একটি ‘কোর টিমে’র মাধ্যমে পরিচালিত হয়। কুইক টিমের প্রতিটা ক্যাটাগোরিতে একজন করে লিডার রয়েছে। ওই লিডারের মাধ্যমে কাজগুলো খুব সহজেই সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হয়।


এই টিমের মাধ্যমে প্রতি মাসে ফ্রিল্যান্সারদের কাজ করার উপর আয় হয়। কোনো মাসে ভাল আবার কোনো মাসে একটু কম আয় হয়ে থাকে। কাজ কম থাকার পরেও কুইক টিম প্রতি মাসে ১৫-২৫ হাজার ডলার আয় করে থাকে। এই টিমের ৫০০ জন সদস্যের মাসে গড় আয় হয়ে থাকে ২৫/৩০ হাজার ডলার।


ফ্রিল্যান্সিং জীবনে দুঃসময়ের অভিজ্ঞতা বিষয়ে নোমান বলেন, আমি যখন প্রথম ফ্রিল্যান্সিং শুরু করি তখন বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। জেলা পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে ইন্টারনেট সেবা নিয়ে, যা রাজধানীর তুলনায় তিনগুন টাকা বেশি দিয়ে ইন্টারনেট বিল পরিশোধ করতে হয়। তাও আবার রাজধানীর মতো করে ভালো দ্রুতগতির ইন্টারনেট পাওয়া যায় না। অন্যদিকে কপি করে কাভার লেটার জমা দিয়ে আমি ২ বার সাসপেন্ড হয়েছি। তৃতীয়বারের মতো যখন আমাকে ওডেস্ক থেকে সতর্ক করা হয়, তখন খুব ভয়ের মধ্যে থাকতাম যে, কখন অ্যাকাউন্ড আবার সাসপেন্ড হয়ে যায়। তার উপরে নতুন অবস্থায় ২/৩ টা বায়ার টাকা না দিয়ে চলে যায়। এতো সব বাঁধার মুখোমুখি হয়েও কাজের হাল ছাড়িনি।



তিনি বলেন, শুধু কি তাই? ফ্রিল্যান্সিংকে নিয়ে শুরু থেকেই অনেকেই নানান ধরনের উপহাসমূলক কথা বলতো, হাসি-ঠাট্ট্রা করতো এবং এখনও বলে ও করে। এসব নিরবে হজম করে গেছি। নিরুসাহিত না হয়ে আর পাওয়ার আশা বাদ দিয়ে শুধু কাজ করে গেছি। কঠোর পরিশ্রম করেছি। হয়ত হাল না ছাড়ার কারণে আজকে আমার এই ভাল একটি অবস্থান।


নোমানের এই সফলতার পিছনে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি তারা হলেন বাবা-মা এবং কলেজের কম্পিউটার শিক্ষক সামিউল হক। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে তিনি আজকে সফলতার দাঁড়প্রান্তে এসেছেন। নোমান তাদের সকলের জন্য দোয়া এবং দীর্ঘায়ু কামনা করেন।


নোমানের ভাষায়, বাংলাদেশের অনেক শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণী রয়েছে। তাদের পর্যাপ্ত মেধা রয়েছে, কিন্তু চাকরি পাচ্ছেন না। অনলাইনে ক্যারিয়ার গঠন করার মধ্য দিয়ে এই সমস্যা দূর করা সম্ভব। বর্তমানে আইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে সঠিক প্রশিক্ষণ আর একটা ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই ওই মেধা খাঁটিয়ে ঘরে বসে আয় করা যায় মাসে হাজারো ডলার। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করার জন্য আইটিকে সঙ্গি করাই বুদ্ধিমানে কাজ। তা না হলে অনেক পিছিয়ে থাকতে হবে আমাদেরকে।


‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং’ প্রকল্পের বিষয়ে এই ফ্রিল্যান্সার বলেন, সরকারের ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নি’ প্রকল্প একটি মহৎ উদ্যোগ। কিন্তু আমরা এটির সঠিক ব্যবহার করতে পাচ্ছি না। বর্তমানে যারা এই ট্রেনিংয়ের আওতায় ট্রেইনার আছেন, তাদের অধিকাংশই অদক্ষ ট্রেইনার। কারণ হচ্ছে তারা নিজেরাই ফ্রিল্যান্সার নয়। সরকার এই প্রজেক্টের মাধ্যমে যদি দক্ষ ফ্রিল্যান্সার তৈরি করতে চায়, তাহলে অবশ্যই স্বীকৃত প্রাপ্ত ফ্রিল্যান্সারদের মাধ্যমে ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ ফ্রিল্যান্সার তৈার করা সম্ভব বলে মনে করি।


বাংলাদেশে রয়েছে অসংখ্য মেধাবী তরুণ-তরুণী। এদের অধিকাংশই বেকার। তথ্যপ্রযুক্তিতে তাদের সম্ভাবনা অফুরান। তাই বাংলাদেশকে একটি বেকারমুক্ত, ক্ষুধামুক্ত এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেন এই সফল ফ্রিল্যান্সার। বর্তমানে তার ‘কুইক টিম’ এ কাজ করছে ৩০জন। আশা করছেন চলতি বছর শেষ নাগাদ আরো ১০০ জন এই টিমে যোগ হবে।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com