শিরোনাম
সিমির জামদানি যাচ্ছে ইউরোপে
প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৪:৩০
সিমির জামদানি যাচ্ছে ইউরোপে
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

বাংলাদেশের নারীরা এখন আর বেকার বসে নেই। ঘর কান্না সামলানোর পাশাপাশি ঘরে বসেই করছেন ব্যবসা। দিন যত যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নারী উদ্যোক্তাদের উপস্থিতি বাড়ছে। বর্তমানে পোশাক, শাড়ি-গয়না থেকে শুরু করে খাদ্যসামগ্রী, ঘর সাজানোর পণ্য, শিশু খাদ্য, প্রসাধন সামগ্রীসহ এমন কিছু নেই, যা অনলাইনে কেনা-বেচা হচ্ছে না। আর ই-কমার্স নামে পরিচিত এ ব্যবসায় নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে।


কাজী শাহনেওয়াজ আফরিন সিমিও এমন একজন উদ্যোক্তা। শুরুতে কারো সহযোগিতা না পেলে নিজ প্রচেষ্টা আর পরিশ্রমে নিজের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। হয়েছেন একজন সফল উদ্যোক্তা। অর্জন করেছেন ক্রেতাদের আস্থা। দেশ ছাড়িয়ে তার তৈরি পণ্য যাচ্ছে সুদূর ইউরোপেও।


এই নারী উদ্যোক্তার জন্ম পঞ্চগড় উপজেলার গলেহাকান্তমনি গ্রামে। বাবা ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মা গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছা ছিল নিজে কিছু করার। নিজের একটি আলাদা পরিচয় তৈরি করার। সামরিক বাহিনীতে চাকরি করারও ইচ্ছা ছিল। কিন্তু এইচএসসি পাস করার পরই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। বিয়ের পর বিবিএ শেষ করেছেন। ইচ্ছা ছিল এমবিএ তে পড়ার। কিন্তু সংসারের নানা ঝামেলায় হয়ে ওঠেনি। চাকরির সুযোগ থাকলেও সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে করা হয়নি। ঘরে বসেই কিছু করার চিন্তা নিয়ে এগোতে থাকেন।



সেই থেকে সিমি দর্জিকে দিয়ে নিজের পছন্দমতো ডিজাইনের ড্রেস বানাতেন। সেগুলোয় সুঁই-সুতা দিয়ে হাতের কাজ করতেন। শাড়ি এবং ওয়ালম্যাট তৈরি করতেন। সামান্য পুঁজি নিয়ে ব্যবসার দিকে হাঁটতে থাকেন। কিন্তু তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। চোখের সমস্যায় সুঁই-সুতার কাজ আর আগায়নি। তখন তার দিন কাটে হতাশায়। কিন্তু সিমি এত অল্পতে দমে যাননি। মনে থাকা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে চেষ্টা করতে থাকেন। পরিবার ও সন্তানকে সময় দেওয়ায় বাইরে চাকরি করা সম্ভব হয়নি। তাই করোনার কথা মাথায় রেখে ভাবেন অনলাইনে ব্যবসা করবেন। ঘরে বসেই প্রোডাক্ট বিক্রি করবেন। সেই থেকে জামদানি ও দেশীয় শাড়ি নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। ‘জুনাইরাস সিক্রেট’ নামে একটি ফেসবুক পেজ খোলেন।


সিমির পেজের সিগনেচার পণ্য ঢাকাই জামদানি শাড়ি। নারায়ণগঞ্জের জামদানি পল্লি থেকে শাড়িগুলো আনা হয়। এছাড়া টাঙ্গাইল ও তাঁতের শাড়ি বিক্রি করা হয়। এগুলো সংগ্রহ করা হয় হোল সেলারদের কাছ থেকে। শাড়ির জন্য বিদেশ থেকেও অনেক অর্ডার আসে। সেগুলো কুরিয়ারের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হয়।


সিমি রান্নাতেও পটু ছিলেন। বিভিন্ন আইটেমের রান্না করে সবাইকে খাওয়ানো তার শখ ছিল। সবাই তার রান্নার প্রশংসা করতেন। তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে শখের রান্না নামে আরেকটি পেজ খোলেন। সেখানে বিভিন্ন আইটেমের রান্না করা খাবারের ছবি দেন। পাশাপাশি গরুর মাংস, চিকেন ফ্রাই, চিংড়ির মালাইকারি, মোরগ-পোলাও, নানা ধরনের পিঠা এবং চাইনিজ খাবার রান্না করে থাকেন। কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী অনলাইনে খাবার বিক্রি করেন।



ব্যবসার হালচাল নিয়ে সিমির সাথে কথা হয় ডেইলি জাগরণে তিনি বলেন, ছোট থেকেই চেয়েছিলাম পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াব। নিজে থেকে কিছু করবো। বাবা মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় চাকরির সুযোগ থাকলেও কোথাও ট্রাই করা হয়নি। নিজে কিছু করার ইচ্ছে থেকেই ২০১৭ সালে পেইজটি খুলি। তখল ভাবলাম দর্জি থেকে নিজে ডিজাইন দিয়ে ড্রেস বানিয়ে সেগুলোতে নিজে হাতের কাজ করবো।কিন্তু সিজারের পর ছোট বাচ্চাকে নিয়ে সেভাবে পারতাম না আর হঠাৎ করে চোখের সমস্যা দেখায় সেটা পুরোপুরি বাদ দিতে হলো।কিন্তু স্বপ্ন দেখা আমার থেমে থাকেনি।


সিমি বলেন, এবার একটু অন্যভাবে ভাবলাম। অনেকে বাধা দিয়েছে কটু কথাও বলেছে দুই একজন সাপোর্ট ও করেছে কিন্তু আমি আমার মনে জোর একত্রিত করে আবার আমার সেই পুরনো পেইজটি নিয়ে ২০২০ সালের শুরুতে জামদানি শাড়ি নিয়ে নেমে পড়লাম। প্রথম দিকে একটু ভয় পেতাম সঠিক বিজনেস পলিসি বুঝতাম না কিন্তু সেল হওয়া শুরু করলো। আমার আগ্রহ বেড়ে গেল। আমি অনলাইন বিজনেস নিয়ে স্টাডি শুরু করলাম, বিভিন্ন ওর্য়াকশপ, সেমিনার এ জয়েন হতাম, এভাবেই ২ মাসের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রের এক কাস্টমারের থেকে প্রায় ৫৫০০০ টাকার বেশি একটি অর্ডার পেয়ে গেলাম। উনি দ্বিতীয়বার আমার কাছে আবার অর্ডার করে আমার রিপিট কাস্টমার হয়ে গেলেন। আমি এভাবেই মনের জোর পেলাম আর আমার স্বপ্ন পূরণের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে গেলাম। আল্লাহর অশেষ রহমতে এখন আমার মাসে প্রায় অর্ধ লক্ষ টাকার উপরে সেল হয়। আমেরিকা, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ থেকেও অর্ডার আসে।


ঘর কান্না সামলে সফল এই নারী উদ্যোক্তা বলেন, অনেকে আমাকে একটা প্রশ্ন করে দুইটা ছোট বাচ্চা নিয়ে কিভাবে আমি দুইটা বিজনেস চালাই আমার কষ্ট হয় না? এই প্রশ্নের সম্মুখীন আমাকে প্রতিনিয়ত হতে হয়। আমি তাদের এই উত্তরই দেই যে না আমার বাচ্চা দুইটা নিয়ে বিজনেস চালাতে কোন সমস্যা হয় না। তবে হাসবেন্ড এর সহযোগিতা ছাড়া এতোদূর আসা সম্ভব হতো না। সে কখনো কোন কাজে আমাকে বাধা দেইনি। সে অর্থনৈতিকভাবে ও মানসিকভাবে আমাকে সাপোর্টদিয়ে গেছে। আমি বিশ্বাস করি কষ্ট আর পরিশ্রম না করলে জীবনে কেউ সফল হতে পারে না। আমার কথা আমাকে পারতেই হবে, একদিন আমার পরিচিতি হবে নিজের একটা ব্র্যান্ড হবে আর এর জন্য তো পরিশ্রম করতেই হবে, তাই না?



অনলাইনে পণ্যের কোয়ালিটি নিয়ে ক্রেতাদের অনেক অভিযোগ থাকে, প্রায় সময়ই দেখা যায় নিম্নমানের পণ্য ক্রেতাকে ধরিয়ে দেওয়া হয় এমন প্রশ্নের উত্তরে সিমি বলেন, আমি সবসময়ই চেষ্টা করি মানসম্মত প্রোডাক্ট দেয়ার। কোয়ালিটির ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ করি না। অনলাইনে অনেক কাস্টমার আছে যারা দাম নিয়ে একটু গিল্টি ফিল করে। এটা বাস্তব সত্য যে ভালো কোয়ালিটির কাপড় নিলে আপনাকে দাম বেশি দিতেই হবে। আপনি যখন কম দামে কোন কাপড় নিবেন তখন সেটা কোয়ালিটি ভালো হবে না। অনলাইনে অনেকে কম দামে খারাপ কোয়ালিটির কাপড় কিনে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। আর এখন কাপড়ের রেপ্লিকার অভাব নেই। অনেকে একি শাড়ি বা কাপড় কেও কম কেও বেশি দামে বেচে যার কোয়ালিটির মধ্যেও অনেক পার্থক্য থাকে। কাস্টমার যেখানে কম দাম দেখে সেখান থেকে কিনে, ফলে ঠকে যায়।


নতুন উদ্যোক্তাদের ব্যাপারে আপনার উপদেশ কী এমন প্রশ্নের জেবাবে সিমি বলেন, সত্যি বলতে আমিও নিজেও তরুণ উদ্যোক্তা। আমি বিশ্বাস করে মনের জোরটাই বড় কথা। কারও কোন কথায় কান না দিয়ে মনের জোরটাকে একত্রিত করে কাজ করে যেতে হবে, তাহলেই সফলতা আসবে।


সব মিলিয়ে সিমির মনে থাকা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছেন। পাশাপাশি মানসম্মত পণ্য বিক্রি করে ক্রেতার চাহিদা পূরণ করে একটি স্থায়ী অবস্থান তৈরি করছেন। এভাবে সিমির প্রতিষ্ঠিত অনলাইন ব্যবসার স্বপ্ন, উদ্যম আর সাফল্যগাথা দেশের হাজারো তরুণ উদ্যোক্তাকে উৎসাহ এবং সাহস জোগাবে।


বিবার্তা/এনকে

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com