শিরোনাম
স্বপ্নগুলো রঙ বদলে ফিরে পেলো নতুন ঠিকানা
প্রকাশ : ০১ জুলাই ২০২১, ১৫:৫৮
স্বপ্নগুলো রঙ বদলে ফিরে পেলো নতুন ঠিকানা
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

মানুষ স্বপ্ন দেখে। সে স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।সময়ের পালা বদলে মানুষের জীবনের প্রতিটা ধাপে ধাপে সে স্বপ্নের রঙ যায় বদলে। জীবনে বেঁচে থাকার জন্য যেমন প্রতিনিয়ত বিভিন্ন চাহিদার বদল হয়, ঠিক তেমনি সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে বাস্তবতা মেনে নিয়ে স্বপ্নের রঙও যায় বদলে।মুনিয়া আফরিনের জীবনেও ঠিক তেমনটি ঘটেছে।


ছোটবেলায় ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন মুনিয়া।পড়াশোনায় ভালো হওয়াতে মায়েরও খুব ইচ্ছে ছিল মেয়েকে ডাক্তার বনানোর। সময়ের সাথে সাথে কখনো বিসিএস ক্যাডার, কখনো পুলিশ অফিসার, কখনো বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আবার কখনো ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হতে চেয়েছেন।জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তার স্বপ্নের রঙ বদল হলেও শেষে ফিরে পেলো নতুন ঠিকানা।


বিবার্তার পাঠকদের জন্য আজ জানাবো স্বপ্নবাজ ও আত্মপ্রত্যয়ী সংগ্রামী নারী মুনিয়া আফরিনের জীবনের গল্প।যার জীবনের বাঁকে বাঁকে রয়েছে নানান ঘাত-প্রতিঘাত ও জীবন সংগ্রাম।



আত্মপ্রত্যয়ী সংগ্রামী নারী মুনিয়া।


রাজবাড়ী জেলার সদর উপজেলায় সজ্জনকান্দার এক সম্রান্ত পরিবারে জন্ম মুনিয়া আফরিনের। বাবা মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। মা গৃহিণী শাহানা হোসেন। মুনিয়ার এক ভাই আছেন। বর্তমানে রাজবাড়ীতে একটি বেসরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে চাকরি করছেন। সেইসাথে উদ্যোক্তা হিসেবেও সমতালে কাজ করছেন। নিজে এখন স্বালম্বী। সমাজে নিজস্ব পরিচিতি তৈরি করতে পেরেছেন।


১৯৯৯ সালে রাজবাড়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগে পাস করেন মুনিয়া। ইচ্ছা ছিল স্টার মার্কস পাওয়ার। খুবই অল্প কিছু নাম্বারের ব্যবধানে স্টার মার্কস পাওয়া হয়নি তার। তারপর ও বিজ্ঞান বিভাগেই ভর্তি হয়েছিলেন রাজবাড়ী সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজে। দুই মাস বিজ্ঞান বিভাগে ক্লাস করার পর হঠাৎই একদিন মনে হলো এসএসসিতে স্টার পাইনি যদি এইচএসসিতেও স্টার মার্কস না পাই তবে তো মেডিকেল কলেজে চান্স পাবো না। কারণ আমি সব সময় অল্প কিছুর জন্যই সে জিনিসটা হারাই।


সেই সময়ে বাংলাদেশে এখনকার মতো এত প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ ছিল না। ফলে নিজের ইচ্ছায় এক মুহূর্তেই বিজ্ঞান বিভাগ থেকে বাণিজ্য বিভাগে পরিবর্তন করেন।ছোটবেলা থেকেই যে কাজটি করতেন তা সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারতেন।বিধায় বাবা-মা কোনোদিন কোনো বিষয়ে তাকে জোর করে চাপিয়ে দেননি।তাই ছোট থেকে নিজে নিজেই নিজের সিদ্ধান্তগুলো নিতে শিখেছিলেন তিনি।


২০০১ সালে বাণিজ্য বিভাগ থেকে এইচএসসি পাস করেন প্রথম বিভাগেই।তখনো মাত্র ১৭ নম্বরের ব্যবধানে স্টার মার্কস পেলেন না। সব সময় মুনিয়ারর জীবনে এমনটাই ঘটেছে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির সময়কাল এতটাই অল্প যে জীবন নিয়ে চিন্তা করার সময় পাননি। সব সময় ভেবেছেন কমার্সের ভালো কোন সাবজেক্টে পড়বেন।পরবর্তীতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স, মাস্টার্স, এমবিএ পাস করেন ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে। তখন থেকে সত্যিকারের স্বপ্ন দেখা শুরু করেন নিজের জীবনটাকে নিয়ে।


বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে একটা ঘটনা বদলে দিলো মুনিয়ার জীবনের দৃশ্যপট। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, অনার্স প্রথম বর্ষে প্রিয় সিরাজুল রাসুল স্যার ক্লাসের সবাইকে প্রথম একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিলেন। বিষয় ছিল ইপিজেড। সেটা শেষ করে যথাসময়ে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিলাম। পরবর্তী ক্লাসে সকলের অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে দেয়া হবে। এমন সময় স্যার একটি অ্যাসাইনমেন্ট সরিয়ে রেখে বাকিগুলা সবাইকে দিয়ে দিলেন। একে একে সবাই অ্যাসাইনমেন্ট পেয়ে যাচ্ছেন। আমি খুবই চিন্তিত ছিলাম আমার অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে। নিজের বুদ্ধি বিবেচনায় আমার কাছে আমার অ্যাসাইনমেন্টই সেরা। তবে স্যার কেন আমারটা দিচ্ছেন না। সবশেষে আমার অ্যাসাইনমেন্টের জন্য আমাকে দাঁড় করালেন। জিজ্ঞাসা করলেন আমি কোন কলেজ থেকে পাস করেছি? আর আমার দেশের বাড়ি কোথায়?


স্যারকে বললাম, আমার গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী। রাজবাড়ীর মতো একটি ছোট জেলা শহর থেকে এইচএসসি পাস করে ওই ব্যাচের প্রায় সাড়ে ৬০০ স্টুডেন্টদের মধ্যে আমি একমাত্র এপ্লাস পেয়েছি। এ পেয়েছিল অনেকেই। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। স্যার হাতের লেখার খুবই প্রশংসা করলেন। আর আমার ক্লাসের প্রতিটা বেঞ্চে সব স্টুডেন্টদেরকে দেখালেন আমার অ্যাসাইনমেন্ট এবং সবাইকে বললেন এক কপি করে ফটোকপি করে নিতে।



ছেলের সাথে মুনিয়া।


ওই ছোট একটা ঘটনা পাল্টে দিলো মুনিয়ার জীবনের ভাবনার দৃশ্যপট। জগন্নাথে ভর্তির পর পর খুব চিন্তা করতেন ঢাকায় তার সাথের ক্লাসমেটরা কেউ ভিকারুন্নেসা, কেউ নটরডেম কলেজে ভর্তি হয়েছিল। তাই তার চিন্তা ছিল জেলা শহর থেকে এসে হয়তো ওদের থেকে ভালো রেজাল্ট করতে পারবেন না। কিন্তু ওই ঘটনার পর তার সব ভাবনা বদলে গেলো। ভাবলেন আজ প্রথম দিন স্যারের কাছ থেকে যে অনুপ্রেরণা পেয়েছি, সেটাই জীবনের শেষ ডিগ্রি পর্যন্ত বহাল রাখতে হবে। সেটাই ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন প্রতিনিয়ত।


এর ফলে প্রতিবছর খুব বেশি নম্বরের ব্যবধানে প্রথম হয়েছেন প্রথম বর্ষে, দ্বিতীয় বর্ষ ও তৃতীয় বর্ষে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক কারণে শুধু মেধা থাকলেই হয় না আরো অন্যান্য কিছুর প্রয়োজন হয় যা মুনিয়ার পক্ষে অসম্ভব ছিল। তাই চতুর্থ বর্ষে এসেও দ্বিতীয় শ্রেণীতে দ্বিতীয়, ওই বছর ব্যবস্থাপনা ডিপার্টমেন্টে কোন প্রথম শ্রেণি ছিল না। আর ওই একই কারণে অনার্সে দ্বিতীয় শ্রেণিতে দ্বিতীয়, মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয়, এমবিএ-তে যৌথভাবে ৩.৮৪। সব জেনে বুঝে কখনোই ঝামেলায় জড়াননি তিনি।


অনার্সের রেজাল্টের পর জীবন নিয়ে আবার নতুন করে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন তিনি। রাত-দিন এক করে প্রতিনিয়ত অবিরাম শুধু পড়াশোনা করে যান। এমনও অনেক সময় পার হয়েছে হোস্টেলে, পড়ার জন্য সময় মতো খেতে না যেতে পারার কারণে পড়ে গিয়ে খাবারও পাননি।


স্বপ্নবাজ মুনিয়া বলেন, মাস্টার্স দিতে দিতে মনে নতুন স্বপ্ন, বিসিএস তো দিচ্ছি, যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারতাম। জগন্নাথের প্রাঙ্গণ খুবই প্রিয় জায়গা, এখানে পড়ালেখা শিখে কর্মজীবন এখানেই শুরু করবো। প্রথম শ্রেণির দ্বিতীয় হলাম মাস্টার্সে। দিল এমবি-এর সার্কুলার, প্রথম ব্যাচ আমরা। মনের দৃঢ়তা বাড়লো। এমবিএ শেষ করলে নিশ্চিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারবো।


চোখ, নাক, মুখ বুঝে দিন-রাত এক করে আবারো শুরু করি শুধু পড়ালেখা। প্রতিদিন অ্যাসাইনমেন্ট, সপ্তাহে মিডটার্ম পরীক্ষা, প্রেজেন্টেশন কিভাবে সময় চলে যেতো খেয়ে না খেয়ে, টেরও পেতাম না। টার্গেট একটাই সর্বোচ্চ জিপিএ পেতে হবে প্রতি সেমিস্টারে। ফার্স্ট সেমিস্টার ফাইনাল এরপরে হলো বিয়ে, তারপরও থেমে থাকিনি। দুজনের নিজেদের পছন্দ থাকায় পারিবারিক সম্মতিতে ধুমধাম করে বিয়ে হলো আমাদের। বিয়ের চার দিন পর ঢাকায় দ্বিতীয় সেমিস্টারের ক্লাস শুরু করি।হাজবেন্ড, শ্বশুর, শাশুড়ি ছিল খুবই পজিটিভ মাইন্ডের। তাই কোন কিছুতে বাধা পায়নি কখনোই, বরং সাহায্য করেছেন অনেকভাবে ওনারা।


এমবিএ-এর শেষ সেমিস্টারে ঢাকা রূপালী ব্যাংক, হাজারীবাগ ব্রাঞ্চ থেকে ইন্টার্নশিপ করেন ছয় মাসের। সাথে সাথে বিসিএস ও ব্যাংকের পরীক্ষা দেয়াই ছিল মুনিয়ার প্রধান কাজ। এখনকার স্বপ্ন হলো বিসিএস প্রশাসন, না হয় পুলিশ। একেবারে কোনটা না হলে ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদ। বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতায় বাদ হয়ে গেল আগের স্বপ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক হওয়া।


জীবনকে নিয়ে আক্ষেপ করে মুনিয়া বলেন, আমার স্বপ্নগুলো শুধু স্বপ্ন হয়েই থাকলো জীবনে, তাকে আর বাস্তবে রূপ দিতে পারিনি। অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেয়ার পর বিসিএসের জন্য চেষ্টা করেছি। একাডেমিক পড়ালেখার পাশাপাশি চাকরির জন্য পড়ালেখা চালিয়ে গেছি সব সময়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমাদের দেশের চাকরির বাজারের অনৈতিক অবস্থার কাছে হেরে গেছি বারবার। তবুও মাথা নত করিনি। ব্যক্তিগতভাবে মানুষটা আমি একরোখা। ছোটবেলা থেকেই বাবার সততা ও ন্যায়-পরায়নতা দেখেই অভ্যস্ত। তাই অনৈতিক বিষয়গুলো কখনোই প্রশ্রয় দেইনি আমি। ফলে যা হবার তাই হলো, সরকারি চাকরির বয়স শেষ। সংসার, বাচ্চা সামলে পুরোদমে গৃহিণী।


সব সময় মুনিয়ার মনের মধ্যে হতাশা কাজ করতো। মন খারাপ লাগতো, সবার সামনে নিজেকে তার খুবই তুচ্ছ বলে মনে হতো। এসব নিয়ে মাঝে মাঝেই অতিরিক্ত চিন্তা করলে অসুস্থ হয়ে যেতেন। বড় ছেলেটার বয়স যখন তিন বছর, তখন টিভিতে রাজবাড়ির একটা লোকাল চ্যানেলে একটা স্কুলের হেড টিচার পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেখেন, যেখানে তার সব যোগ্যতা মিলে যায়। তাই দেরি না করে ওখানে দেয়া ফোন নাম্বারে ফোন করে ছেলেকে নিয়ে চলে যান তখনই।


তাৎক্ষণিক ভাইভা নেয়া হলো তার। শিক্ষক হিসেবে সিলেক্ট করা হলো। ওই স্কুলে তিন বছর চাকরি করতে না করতেই এরই মধ্যেই জানতে পারেন স্থানীয় একটি বেসরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক প্রয়োজন। যোগাযোগ করতেই তারা মুনিয়াকে প্রভাষক হিসেবে নিয়ে নিলেন। একে তো স্কুলের সমস্ত দায়িত্ব তারপর কলেজ। একটি সময়ে স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে শুধু কলেজের চাকরিটি শুরু করে যান সংগ্রামী এই নারী।



কলেজের প্রভাষক মুনিয়া।


বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে হওয়ার কারণে আম্মু কখনোই তাকে ঘরের কোন কাজই করতে দিতেন না। তবে তার আম্মু কিন্তু বিভিন্ন বিষয়ে খুবই এক্সপার্ট ছিলেন। হরেক রকমের রান্নায়, বিভিন্ন ধরনের সেলাইতে। যেকোন কাজই ছিল তার নিখুঁত পরিপাটি।


মুনিয়া প্রথম রান্নার কাজ করেছেন তার হোস্টেল লাইফে। পরে সংসার জীবনে শুরু হলো নিজের সংসারের রান্নার কাজ। প্রথম থেকে আজ অবধি কখনো এমন রান্না করেননি যা কখনো ফেলে দিতে হয়েছে। কারণ তিনি নিজে মায়ের বাসায় রান্না না করলেও মায়ের কাজ সবকিছুই খুবই মনোযোগ দিয়ে দেখতেন, যা সংসার জীবনে নিজের সংসারে খুবই কাজে লেগেছে।


মুনিয়া বলেন, বড় ছেলেটা হওয়ার পর বিভিন্ন খাবার আমি নিজেই ওর জন্য তৈরি করতাম বাসায়। বাইরের খাবারগুলো একদমই দিতাম না ওকে। এছাড়াও বাবার বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি, দাদাবাড়ি, নানা বাড়ি একই জায়গায় হওয়ায় আমার বাসায় প্রায়ই মেহমান আসতো। আমি বিকালের নাস্তার জন্য বিভিন্ন ফ্রোজেন আইটেম বানিয়ে ফ্রিজে রাখতাম, যা নিজেদের নাস্তার পাশাপাশি মেহমানদেরকেও দিতাম। সবাইকে খুবই প্রশংসা করত। পিঠার সময় পিঠা, আচারের সময় আচার তৈরি করতাম নিজের সংসারের জন্য, আত্মীয়-স্বজনসহ অন্যদেরকেও দিতাম।


ছোটবেলা থেকেই আমার আম্মু নিজেই নারিকেল তেল তৈরি করত বাসায় আমার ও আমার আম্মুর চুলে ও ত্বকে দেয়ার জন্য। তার কাছ থেকে শিখেছি নারিকেল তেল তৈরি করার পদ্ধতি। এছাড়াও গরুর দুধের সর থেকে আম্মু ঘি তৈরি করতে বাসায়। এটাও মায়ের কাছ থেকেই শেখা। আমার বাসায় যে গরুর দুধটা রাখা হতো খুবই খাঁটি ছিল, ওই দুধের সর জমিয়ে আমিও বাসায় তৈরি করতে লাগলাম ঘি। এতটা ঘি হতো যে,আমার সংসারের চাহিদা মিটিয়েও মাঝে মাঝে শাশুড়ি ও নিজের মাকে দিয়েছি। যার ফলে পরিচিত অনেকেই যারা আমার বাসায় আমার হাতে তৈরি করা খাবার খেয়েছেন, অনেকবার আমাকে বলেছেন এত ভাল রান্না একটা রেস্টুরেন্ট দাও খুব ভালো চলবে, কিন্তু কখনো কথাগুলো কানে তুলেনি আমি।


গতবছর লকডাউনে যখন কলেজ ছুটি, ওই সময়ে ফেসবুকের কল্যাণে উই গ্রুপের সন্ধান পান মুনিয়া। যেখানে লাখো উদ্যোক্তা বিভিন্ন প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করছেন। ওই সময়ের সকলের পোস্ট পড়ে তার মনে হয়েছে আমিও তো অনেক কিছুই পারি, তাহলে এখন সেগুলো কাজে লাগাতে পারি। যেমন ভাবা, ঠিক তেমনি কাজ শুরু করা। লকডাউনে সরকার থেকে সকল বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদেরকে ৫০০০ হাজার টাকা করে সম্মানী দেয়া হয়েছিল। ওই টাকা থেকে প্রথম ডেলিভারি করা প্রোডাক্টের কাঁচামাল কিনেছিলেন মাত্র ১৫০টাকার। এভাবেই শুরু তার ফুড আইটেম নিয়ে অনলাইনে কাজ।


পেজ খোলার আধাঘন্টার মধ্যে দুইটা অর্ডার কনফার্ম হয়েছিল ওই দিন। সে দিনের কথা বলতে গিয়ে মুনিয়া বলেন, সেই দিনটি আমার জীবনের একটা স্মরণীয় দিন, যা ভোলার নয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার আমার আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব যারাই আমার বাসায় আমার হাতে তৈরি করা খাবার একবার ও খেয়েছেন, তারাই আমার এখন রেগুলার কাস্টমার, আলহামদুলিল্লাহ।


তার উদ্যোগের নাম ‘হরেক সদাই’। আর উদ্যোগের ট্র্যাগ ‘শুদ্ধতাই সুস্থতা’। ‘হরেক সদাই’ এর যাত্রা শুরু হয় ২০২০ সালের ১০ জুলাই। ফ্রেশ, খাঁটি ও গুণগত মানসম্পন্ন পণ্যগুলো সকলের কাছে পৌছে দেয়াই ‘হরেক সদাই’ এর একমাত্র উদ্দেশ্য। কাজ করছেন ফুড আইটেম নিয়ে। এর মধ্যে আছে, হোম মেড ফুড, ফ্রোজেন ফুড, সিজনাল আচার, বিভিন্ন ধরনের পিঠা, হোমমেড ঘি, হোমমেড নারিকেল তেল (ত্বক ও চুলের দুটি ভিন্ন), ঘানিতে ভাঙ্গানো সরিষার তেল, চাকের মধু, খেজুরের গুড়ের পাটালি, আখের গুড় ও রাজবাড়ীর ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন।


জীবনের কষ্টের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুনিয়া বলেন, সে দিনগুলোর কথা মনে পড়লেই নিজের অজান্তেই আজো চোখে পানি চলে আসে। নিজের অপারগতার কথা, নিজের অপমানিত হওয়ার কথা, সবার চোখে নিজেকে ছোট হয়ে যাওয়ার কথা, মনে পড়লেই নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না।


শশুরের বাড়িতে সবাই যখন একসাথে থাকতাম, প্রায় প্রতি মাসেই বাসায় কোনো না কোনো দূরের মেহমান আসতো বাসার ছোট বউ হাওয়াতে ও দীর্ঘদিন ঢাকাতে থাকার কারণে পরিবারের অনেকেই জানতো ছোট বউ খুবই ভালো স্টুডেন্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করছে, অনেক ভাল রেজাল্ট, বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছে নিশ্চিত এবার বিসিএস ক্যাডার হয়ে যাবে। যখন কিছুই হলো না, বড় ছেলেটার বয়স একমাস এমনই একটি সময়ে আত্মীয়-স্বজনের চোখের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেও খুব লজ্জা লাগতো, কথা বলতে সংকোচ বোধ করতাম। এমনকি পরিবারের অনেকেই আড়ালে এমনও কথা বলেছেন কিসের ভালো স্টুডেন্ট একটা সরকারি চাকরি জোটাতে পারে না। মুখোরোচক গল্পের টপিক ছিলাম আমি। সকলের আড়ালে কত কেঁদেছি, যা আমি ছাড়া অন্য কেউই জানে না।


একবার নানা বাড়িতে পারিবারিক এক অনুষ্ঠানে রাজবাড়ির এমপি সাহেব আসেন। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সকলের সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলেও, আমার বেলায় মুখ বন্ধ, কারণ আমি বেসরকারি কলেজের প্রভাষক। বিসিএস পাস করে সরকারি কলেজের প্রভাষক হতে পারিনি। বিসিএস পাস করে সরকারি কলেজের প্রভাষক হলে হয়তো গর্বের সাথে পরিচিত করে দিতো। সকলের মধ্যে অযোগ্য আমি। সবাই ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই স্থান ত্যাগ করেছি তখন। ওখানে এত এত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি বর্গ ছিলেন যেখানে আমি খুবই নগণ্য একজন ব্যক্তি।



স্বপ্নবাজ নারী মুনিয়া আফরিন।


ছোটবেলা থেকেই আমার মায়ের খুবই দুঃখ, তার মেয়ের কোনো চাহিদা নেই। কি ঈদ, কি জন্মদিন। মা-বাবা যা কিনে দিতো তা নিয়েই খুশি থাকতাম সব সময়। মনে পড়ে না কোনদিন কিছু আবদার করে বলেছি আমাকে এটা কিনে দাও। যখন স্কুলে পড়েছি তখন ১০ টাকা প্রতিদিন ও যখন কলেজে পড়েছি তখন ৩০ টাকা প্রতিদিন রিক্সা ভাড়া হিসেবে বরাদ্দ ছিল আমার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার কারণে যখন ঢাকাতে থাকতে শুরু করলাম হোস্টেলে তখন আব্বু প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট অ্যামাউন্ট দিতেন যা আমার হাত খরচসহ হোস্টেল খরচ। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় ফি যা ছিল ঠিক তাই নিতাম আব্বুর কাছ থেকে। সব সময় নিজের জিজ্ঞাসা করে করে টাকা দিতেন আব্বু আর কিছু বেশি দিতেন যেহেতু তাদের থেকে দূরে থাকি।এছাড়াও আব্বু-আম্মু জানতেন কষ্ট হলেও টাকা চাইতে খুবই লজ্জা আমার, তাই এভাবেই কেটে গেল স্টুডেন্ট লাইফ।


পরবর্তীতে এলো নিজের সংসার, তখনও কোনো চাকরি হয়নি আমার। বর চাকরিজীবী। আর সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব তার কাঁধেই। আগে থেকেই পরিচিত থাকার কারণে আমার বরও জানতো আমার এই টাকা না চাওয়ার বিষয়টা। তাই প্রতি মাসের শুরুতেই অন্যান্য খরচের সাথে সাথে আমার হাত খরচের জন্য কিছু টাকা বরাদ্দ থাকত, যা খরচ তেমন না হলেও জমাই থাকতো আমার কাছে। প্রয়োজনীয় সবকিছু সে নিজে থেকেই কেনাকাটা করায় আমার হাত খরচের টাকাগুলো প্রতিমাসে জমাই থাকতো।


২০১৯ সালের মাঝামাঝির দিকে একটা সার্কুলার দেখলাম অনলাইনে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে ডিসেম্বরে। অনেক আগে থেকেই মনে মনে আশা করেছি এই দিনটির জন্যে, যখন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের খবর দেখতাম টিভিতে মনে মনে খুব ইচ্ছা হতো আমাদেরটা কবে হবে।


রেজিস্ট্রেশনের জন্য যে সময় দেয়া হলো তার কিছুদিন আগে বরের দেয়া হাত খরচের জমানো টাকা একটা ভাল কাজে লাগান। কারণ তখন তার হাতে খুব বেশি টাকা ছিল না। নিজের স্বভাবসুলভ আচরণে বরকে বিষয়টি জানাননি। জানালে অবশ্য বর কোনোদিনও না করতেন না। এদিকে সময় চলে যাচ্ছে বার বার ভাবছেন ওই প্রোগ্রামের সব বন্ধু-বান্ধবীরা আসবে, কতদিন পর সবার সাথে দেখা হবে। আবার ভাবছেন সবাই ভালো ভালো জায়গায় প্রতিষ্ঠিত কিন্তু আমি সামান্য বেসরকারি কলেজের প্রভাষক বেতন নাই বললেই চলে। মনে মনে খুবই হীনমন্যতায় ভুগছিলেন তিনি। আজোও বরকে জানতে দেননি মনের এই কথাগুলো। এটা মনে পড়লেই খুব কষ্ট পান নিজে নিজে।


মুনিয়া বলেন, আজ আমার নিজের অর্জিত টাকা আছে, আজ আমার ‘হরেক সদাই’আছে, আজ আমাকে যে এমপি সাহেবের সাথে পরিচিত করতে লজ্জা পেয়েছিল, সে নিয়মিত খোঁজ নেয়, যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করে, আজ আমি শশুরের বাড়ির ওই আত্মীয়-স্বজনের সামনে নিজের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি, কথা বলতে পারি, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস রেখে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারি।


নানান ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েও জীবনের বেশ কিছু অর্জন হয়েছে মুনিয়ার জীবনে। তিনি বলেন, নিজের ও নিজের কাজের প্রতি আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে পেরেছি, যা একদমই হারিয়ে ফেলেছিলাম। অন্যের সাহায্য ছাড়াই নিজে নিজেই স্বাবলম্বী হতে পেরেছি, আলহামদুলিল্লাহ।


স্টুডেন্ট লাইফে পড়াশোনা নিয়ে যতটা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, ঠিক সেই আত্মবিশ্বাস আবার নতুন করে ফিরে পেয়েছেন মুনয়িা। সময়ের সাথে সাথে নিজের কাজের মাধ্যমে নিজেকে নতুনভাবে তৈরি করতে পেরেছেন। পড়াশোনা করেছেন যেহেতু ম্যানেজমেন্ট বিষয় নিয়ে, তাই ব্যবসায়ের বিভিন্ন সম্পর্কিত বিষয়গুলো সুন্দরভাবে হ্যান্ডেল করতে পারছেন নিজের ব্যবসায়। নিজের সৃজনশীলতা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের নামের পাশে উদ্যোক্তা শব্দটি বসাতেও পেরেছেন।


উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) গ্রুপের মাধ্যমেই র শুরু তার উদ্যোক্তা জীবনের। উদ্যোক্তার জীবনের শিকড় হলো উই গ্রুপ। মুনিয়া উই গ্রুপে আছেন ২০২০ সালের ত জুলাই থেকে। প্রথম পোস্ট করেছেন ১০ জুলাই। তখন থেকে আজ পর্যন্ত নিয়মিত আছেন।৩ জুলাই উইতে তার পূর্ণ হবে এক বছর।


মুনিয়া বলেন, প্রথমদিকে রাজিব আহমেদ স্যার ও নাসিমা আক্তার নিশা আপুর দেয়া পোস্টগুলো নিয়মিত পড়তাম। যা থেকে পেয়েছি অনেক অনেক অনুপ্রেরণা। এছাড়াও অনেক আপুও ভাইয়াদের পোস্ট পরেছি নিয়মিত।কিছু কিছু আপুদের জীবনের গল্প থেকে অনেক অনেক বেশি শিক্ষনীয় বিষয় শিখেছি। তাদের নিজেদের ঘুরে দাঁড়ানোর বিভিন্ন পোস্ট পরেছি। এগুলো পড়ে পড়ে নিজের ভেতর আত্মবিশ্বাস তৈরি হলো। কলেজ ছুটি থাকার কারণে তখন বাসায় বসে ছিলাম। তাই নিজের সময়কে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগানোর জন্যই নিজের যেসব কাজ পারি তা নিয়েই উদ্যোগ শুরু করলাম। তখন থেকে আজ পর্যন্ত আর থেমে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।



খাবার অর্ডার প্রস্তুত করছেন উদ্যোক্তা মুনিয়া।


উইতে প্রতিনিয়ত একটিভ থাকার ফলে নিজের পণ্যের মাধ্যমে সবার মাঝে নিজের একটা পরিচিতি তৈরি করতে পেরেছেন তিনি। রাজবাড়ী জেলা থেকে সর্বপ্রথম মুনিয়া উই গ্রুপের কভার ফটোতে এসেছেন।মাত্র বিশ দিনের ব্যবধানে দুই বার।এছাড়াও উইয়ের পক্ষ থেকে রাজবাড়ী জেলাসহ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন।


তার ভাষ্য মতে, উই থেকে পাওয়ার কোনো শেষ নেই। সবচেয়ে বড় কথা নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছে উই। উই না থাকলে হয়তো আমার সৃজনশীল কাজগুলো চাপা পড়েই থাকতো, কখনো সকলের সামনে প্রকাশিত হতো না। উইয়ের সাপোর্টে এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। সব সময় ভালোবাসি উইকে। উই এর সাথে আছি আগামীতেও থাকবো ইনশাআল্লাহ। আমার জীবনের রূপরেখাই বদলে দিয়েছে উই। অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি রাজিব আহমেদ স্যার ও নাসিমা আক্তার নিশা আপুকে, যাদের তৈরি করা প্ল্যাটফর্ম উইয়ের মাধ্যমে ও অনুপ্রেরণায় এতদূর পর্যন্ত আসতে পেরেছি আমি।


‘হরেক সদাই’কে নিয়ে অনেক দূর যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন মুনিয়া। উদ্যোগটা ধীরে ধীরে আরো বড় হবে, এখানে অনেক বেকার নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। এছাড়াও ‘হরেক সদাই’ একদিন এমন একটি ব্যান্ড হবে, যাতে করে এক নামে সবার কাছে পরিচিত হবে এবং এর গুণগত মানসম্পন্ন পণ্যের উপরে নিশ্চিন্ত মনে আস্থা রাখবে সবাই।


বিবার্তা/গমেজ/জাই


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com