শিরোনাম
উদ্যোক্তা ইয়াছিন আকতার ইমুর জীবন সংগ্রাম
প্রকাশ : ০২ মে ২০২১, ২২:৫০
উদ্যোক্তা ইয়াছিন আকতার ইমুর জীবন সংগ্রাম
বিপাশা দাশ
প্রিন্ট অ-অ+

একজন নারী উদ্যোক্তাকে শুরু থেকে নানা প্রতিকূল পরিবেশের মোকাবেলা ও অনেক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। আর এসব পরিস্থিতির মোকাবেলা সবাই করতে পারেন না। যার মনে আন্তরিক সদ্বিচ্ছা ও দৃঢ় মনোবল আছে তারাই কেবল অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে এসব জয় করতে পারেন। আর জীবন সাথী যদি হয় বন্ধুর মতো, তাহলে যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করা হয়ে যায় আরো সহজ। এ কথাটাই বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে একজন আত্মপ্রত্যয়ী নারী উদ্যোক্তার জীবনে। উদ্যোক্তা জীবন শুরু করার সময় তার অনেক চ্যালেঞ্জ এসেছিল। যখন হাজবেন্ড পাশে এসে দাঁড়ালেন তখন সেই চ্যালেঞ্জগুলো দুজনে এক সাথে মোকাবেলা করতে অনেকটা সহজ হয়ে গেল। আজ তিনি সফল উদ্যোক্তা।


বলছিলাম বন্দরনগরী চট্টগ্রামের নারী উদ্যোক্তা ইয়াছিন আকতার ইমুর কথা। শূন্য থেকে শুরু করে নিজের চেষ্টা, অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে আজ তিনি নিজের একটা আলাদা পরিচয় তৈরি করতে পেরেছেন। শুধু ইয়াছিন আকতার ইমু থেকে তিনি সফল নারী উদ্যোক্তা। এই পথটা সহজ ছিল না। অনেক কঠিন পরিক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে। পদে পদে ছিল নানান চ্যালেঞ্জ। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে তিনি আজ সফল হয়েছেন।


ইমুর জন্ম সাতকানিয়া জেলায় হলেও তার বেড়ে উঠা চট্টগ্রাম মহানগরীতে। এখানেই কাটে তার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলজীবন। কামাল ইশকে মুস্তফা (স) মাদ্রাসা থেকে এসএসসি পাস করার পরে ভর্তি হন মেট্রোপলিটন সায়েন্স কলেজে। সেখান থেকে পাস করেন এসএসসি। তবে তার এইচএসসি পরীক্ষা দেয়া এতো সহজ ছিল না। কারণ কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে উঠার পর পরই বিয়ে হয়ে যায়। এরপর প্রেগন্যাসির অবস্থা নিয়েই তাকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। সময়ের আবর্তনে তার কোল আলো করে আসে ছেলে সন্তান। তখন স্বামী, সন্তান এবং সংসারে পুরোপুরি সময় দিতে হতো। কেউ তাকে কোনভাবে সাপোর্ট দেননি। এর জন্য তার পক্ষে আর পড়ালেখা করা হয়ে উঠেনি।



ইমুর হাতে তৈরি করা পোশাক।


আর পাঁচটা সাধারণ সাবলম্বী নারীর মতো ইমুরও ইচ্ছে ছিল পড়ালেখা করে কিছু একটা হবেন। নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। নিজের পরিচয় তৈরি করবেন। সেই পরিচয়ে সমাজে মানুষ তাকে চিনবে। ভাগ্যদেবী তার আর প্রসন্ন হয়নি। সে স্বপ্ন তার রয়ে গেছে অধরাই। সেই স্বপ্ন যখন আর পূরণ হয়নি তখন আবার চিন্তা করলেন জীবনে হেরে গেলে চলবে না। আমাকে আবার পড়ালেখাটা শুরু করতে হবে। তখন পড়ালেখা শুরু করার মানসিক প্রস্তুতি নিলেন ইমু। যেই মন থেকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখনি আবার প্রেগন্যান্ট হয়ে যান। প্রথম ছেলের বয়স তখন মাত্র ১৫মাস। যেহেতু প্রথম বাচ্চা সিজার কারা, আর সাথে আরও জটিল সমস্যা ছিল, তাই দ্বিতীয় বাচ্চার সময় পড়ালেখা করানো নিয়ে আর কেউ ঝুঁকি নিলেন না।


ইমু সবসময় ইচ্ছে হতো নতুন কিছু করতে। তার আম্মু খুব ভাল সেলাই কাজ পারতেন। আম্মু যখন সেলাই করতেন তখন কাছে বসে বসে সেগুলো দেখতেন। এভাবে দেখে দেখে কিছু কাজও শিখে ফেলেন। সেখান থেকেই তার সেলাইয়ের অভিজ্ঞতা হয়। ট্রেইলারিং কাপড়ে বিভিন্ন ডিজাইন করতে দেখতে তার খুব ভাল লাগতো। কলেজে পড়ার সময় টিউশনের পাশাপাশি নিজের এলাকার টেইলার থেকে একটা দুইটা করে কাপড় নিয়ে সেলাই করতেন আর সুন্দর সুন্দর ডিজাইনগুলো বেছে বেছে নিতেন টেইলারের মাস্টার থেকে। প্রেগন্যাসির অবস্থায় যখন বাসায় বসে বসে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলেন তখন ইমু একটা অলাইনে জব করতেন। তখন বাসায় কেউ জানতেন না।


২০১৭ সাল। নিজে থেকে কিছু করার সিন্ধান্ত নেন ইমু। মনের ইচ্ছের কথা জানান হাজবেন্ডকে। সব শুনে রাজি হয়ে যান হাজবেন্ড। কিন্তু কী কাজ করবেন সেটা ভেবে পাচ্ছেন না। ভাবতে থাকেন। হঠাৎ মাথায় আসে টেইলারিংয়ের কথা। যেহেতু সেলাইয়ের সাথে কাটিং দুইটাই তিনি পারেন আর নতুন নতুন ডিজাইন করতে ভাল লাগতো, তাই এই দক্ষতাকে পুঁজি করেই নতুন কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন। পরিকল্পনা করেন কীভাবে কি কাজ করবেন। সে মতে কাস্টমাইজ অর্ডার দিয়ে শুরু করেন একটা অনলাইন ব্যবসা।



উদ্যোক্তা ইয়াছিন আকতার ইমু।


পরিকল্পনা অনুসারে ফেসবুকে একটা পেজ খুললেন। ওই পেজে কাজের বিষয়ে পোস্ট ও প্রচার চালানো শুরু করে দেন। তারপর আগের সেলাইয়ের কাজ করে জমানো টাকা থেকে কিছু টাকা নিয়ে সেলাই মেশিন কিনেন। নিজের কাজ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ে বেশি সময় দিতে থাকেন। বিভিন্ন লোকাল গ্রুপে পোস্ট করার কয়েকদিনের মধ্যে অর্ডার আসা শুরু হল তার।


ওই সময়টাতে চট্টগ্রামে একটা জাপানি সিল্কের শাড়ি এবং তসর ব্লাউজ খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ক্রেতাদের পছন্দকে পুঁজি করে সে শাড়িসহ আস্তে আস্তে যোগ করেন নিজের হাতের কাজ করা সিকুয়েন্স, পার্ল, স্টুন ওয়ার্ক করা ড্রেস ও রেপাল শাড়ি। পাশাপাশি এমব্রয়ডারি কারছুপি কস্টমাইজ করাও অর্ডার নিতেন।


নিজের স্বামী, সন্তান, সংসার সামলে একজন গৃহিনীর পক্ষে কোন উদ্যোগকে শূন্য থেকে দাঁড় করাতে কত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয় সেটা যারা করেন তারাই বুঝেন। ইমুও সব সামলাতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছিলেন। তবে জীবন সাথী হিসেবে ভাল একজন হাজবেন্ড পাওয়াতে সে কাজটা অনেকটা সহজ হয়ে গিয়েছিল। সব অবস্থায় হাজবেন্ড পাশে ছিলেন বন্ধুর মতো। তাই সব পরিস্থিতি মোকাবেলা করে তিনি এগিয়ে যান।


নিজের পেজ আর বিভিন্ন লোকাল গ্রুপে পোস্ট করে উপরওয়ালার ইচ্ছায় অনেক ভালই চলছিল ব্যবসাটা। প্রথম সন্তানকে স্কুলে দেওয়া জন্য ২০১৯ সালের শুরুতে এসে তাকে বিগত সাড়ে ২বছরের ব্যবসা ইতি টানতে হয়। অন্যদিকে ছোট মেয়েটা ৮ মাসে জন্ম হওয়াতে প্রায় অসুস্থ থাকতো। এছাড়াও শ্বশুর বাড়িতে এক মাত্র বউ হওয়াতে তাকেই সামলাতে হচ্ছিল সব কিছু। এসব কারণে হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায় তার অনলাইনের সব ধরনের কাজ। সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে অফলাইন সেলাইয়ের অর্ডার নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন।


২০২০ সালে এসে ইমুর শ্বশুর-শাশুড়ি অস্ট্রেলিয়ার চলে যান। দেশে শুরু হয় করোনার প্রোকোপ। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এই কারণে ছেলেকে আর স্কুলে দেওয়া হয় নাই। সব মিলিয়ে পেন্ডামিক অবস্থায় যাওয়ার আগে সংসারের সব কাজ সারাদিন করার পর তার কাছে কাজ করার মতো সময় থাকতো। তাই আবার অনলাইনের কাজ শুরু করেন ইমু। লউকডাউন শুরু হওয়ার আগে সব ধরনের মার্কেট বন্ধ হওয়া কথা শুনে বেশি করে গজ কাপড় স্টক করে রাখেন। উদ্দেশ্য গজ কাপড় দিয়ে সব ধরনের কাস্টমাইজ পোশাক অর্ডার নিতে পারবেন।



ইমুর হাতে তৈরি করা পোশাক।


এরই মাঝে একদিন হাজবেন্ড তার সাথে অনলাইনে নারী উদ্যোক্তাদের জনপ্রিয় উইম্যান অ্যান্ড ই কামার্স (উই) গ্রুপের কথা বলেন। গ্রুপের প্রশংসাও করেন। উই গ্রুপের লিংক দেন। দিয়ে বলেন যাতে গ্রুপটাতে জয়েন করে একটু কাজগুলো দেখে নেন। হাজবেন্ডের কথায় ইমু প্রথমে বেশি গুরুত্ব দেননি। কারণ ভেবেছেন কত গ্রুপই তো দেখেছি। উইও তেমনই একটা গ্রুপ হবে। বিষয়টা অবহেলা করলেও গ্রুপে জয়েন হয়েছেন ঠিকই।


প্রতি দিনকার মতো ফেসবুকে স্ক্রল করার সময় একদিন হঠাৎ উইয়ের উপদেষ্টা রাজিব আহমেদ এর একটা পোস্ট চোখে পড়ে তার। আর আগে যেহেতু শাড়ি নিয়ে আর দেশীয় কিছু কাপড় নিয়ে কাজ করেছেন, তাই পোস্টটি তার ভালোই নজর কাড়ে। তারপর গ্রুপের অন্যান্য পোস্টও পড়তে থাকেন। আর এভাবেই উইয়ের প্রতি তার ভালোলাগার শুরু। ২০২০ সালের ১৩ জুন ইমু প্রথম উইতে তার পরিচিতি পোস্ট দেন। পোস্ট করার নিয়ম নিয়ে উইয়ের প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশার পোস্ট ভালো করে খেয়াল করেন। উইতে জয়েন হওয়ার পর পার্সোনাল ব্যান্ডিং নিয়ে একেক জনের পোস্ট ভালোভাবে খেয়াল করেন আর পড়তে থাকেন। যখন সময় পান চলে যান উইতে।


লকডাউনে তার হাসবেন্ড যেহেতু ঘরে বসা ছিল। উইয়ের অনুপ্রেরণায় সেও একটা উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু করেন। উদ্যোগটা হলো চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী খাবার মোচার ভাত। উদ্যোগের নাম ‘বরক’(borok). আর নিজে রাঁধুনী হিসাবে কাজ করেছেন। অন্যদিকে ইমুর উদ্যোগে নাম ‘আঙরাখা’ (Angrakha)।‘আঙরাখা’তে কাজ করছেন নামাজের হিজাব ও কাস্টমাইজ করা মেয়েদের সব ধরনের পোশাক নিয়ে। এছাড়াও মধু ও কালোজিরার তেল নিয়েও কাজ করছেন।


মহামারি করোনার প্রভাবে সারাবিশ্ব ও দেশের সব কিছু যখন স্থবির হয়ে গেছে তখন নিজের উদ্যোগের পাশে হাজবেন্ড এসে দাঁড়ানোর কারণে মহামারি করোনার সময়েও তারা বেশে বেশ ভালভাবে চলছেন। আয়ও ভাল হচ্ছে। ইমু এই ভাল থাকার সব ক্রেডিট দিতে চান উই গ্রুপকে। কেননা উইয়ের হাত ধরেই তারা দুইজনেই এখন ভালো মানের উদ্যোগক্তা হয়েছেন। ইমু বলেন, শুরুতে গ্রুপটাকে বেশি গুরুত্ব না দিলেও জয়েন হয়েই বুঝতে পেরেছি এটা একটা ভিন্ন মানের গ্রুপ। এখানে রয়েছেন উদ্যোক্তা জগতের সবচেয়ে ভাল একজন মেন্টর। শ্রদ্ধেয় রাজিব আহমেদ স্যার। গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট প্রিয় নাসিমা আক্তার নিশা আপু। কীভাবে পার্সোনাল ব্যান্ডিং, অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনা করতে হয় সব কিছু উইয়ের ফ্রি ট্রেনিং, ওয়ার্কশপ আর মাস্টারক্লাসের মত বিভিন্ন মূল্যবান কোর্সে অংশগ্রহণের সুযোগে শিখেছি। আজকে আমাদের এই সাফল্যের পেছনে এই ‍দুইজন ব্যক্তির সবচেয়ে বেশি অবদান। তাই মহান এই দুই ব্যক্তির প্রতি রইল অন্তর থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও অশেষ কৃতজ্ঞতা। দোয়া করি দুজন ব্যক্তি যেন সব সময় সুস্থ থেকে আমাদের পাশে এভাবে থাকতে পারেন আর আমাদের মেন্টর হিসেবে সাহায্য করতে পারেন।



বাবার সাথে ছেলে ও মেয়ে।


স্বপ্নের উদ্যোগকে নিয়ে ভবিষ্যতে অনেক দূর এগিয়ে যেতে চান অদম্য আত্মপ্রত্যয়ী এই উদ্যোক্তা। ইমু বলেন, আমার স্বপ্ন এখন একটাই, সেটা হলো নিজের হাতে বানানো কাস্টমাইজ করা জিনিসগুলা এবং আমাদের দেশীয় পণ্যগুলা দেশবিদেশ ছড়িয়ে দেওয়ার। যারা ঘরে বসে অলস সময় পার করছেন তাদের প্রতি বলবো মনে একটা সদ্বিচ্ছা আর পরিকল্পনা থাকলে শূন্য থেকে ভাল একটা অবস্থানে যাওয়া কঠিন কিছু না। আমি আজ যা হয়েছি এটা সবার দোয়াতে। সবাই আরো দোয়া করবেন যাতে আমি আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারি।


লেখক : নারী উদ্যোক্তা, ফাউন্ডার ও স্বত্বাধিকারী, অনলাইন প্লাটফর্ম ‘রমনীয়’।


বিবার্তা/গমেজ/জাই


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com