শিরোনাম
সোনালী আঁশ নিয়ে এগিয়ে যেতে চান সুরাইয়া শারমিন
প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২০, ২০:৩৯
সোনালী আঁশ নিয়ে এগিয়ে যেতে চান সুরাইয়া শারমিন
নাজমুন নাহার নুপুর
প্রিন্ট অ-অ+

আমি আব্বাকে যখন বলতাম, আমি বিজনেস করবো আর আপনার পেনশনের সব টাকা আমাকে দিয়ে দিতে হবে। আব্বা হেসে বলতেন, আমার পাগলী মেয়ে। তোমাকে বিজনেসের জন্য টাকা দিলে তুমি পনেরো দিন এত গরম থাকবা যে তোমার কাছে কেউ যেতেই পারবে না। তারপর একমাস পরে যখন সব টাকা শেষ হবে তখন ঠাণ্ডা হয়ে ঘরে শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়বে। সরকারি চাকুরে আব্বার সেই মেয়েটি আজ হয়ে গেলেন উদ্যোক্তা।


বলছিলাম অনলাইন প্লাটফর্ম ‘সুরাইয়া’র স্বত্বাধিকারী নারী উদ্যোক্তা সুরাইয়া শারমিনের কথা।



নারী উদ্যোক্তা সুরাইয়া শারমিন


ঢাকার মহাখালী নিজের বাড়িতে জন্ম সুরাইয়ার। চার বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি মেজো। আব্বা সরকারি চাকুরে। আম্মা ছিলেন পরিশ্রমী একজন নারী। সব সময় কিছু না কিছু করতে পছন্দ করতেন তিনি। ওয়াইডাব্লিউসিতে বেশি কিছু দিন সেলাইয়ের টিচার হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়াও গুলশানে আইডিয়াস নামের একটা শোরুমের সাথে যুক্ত ছিলেন। সেখানে নকশি কাঁথার কিছু কাজ করে দিতেন। এভাবে সব সময়ই তিনি পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করার চেষ্টা করতেন।


সুরাইয়ার পরিবারটি ছিলো সংস্কারমুক্ত একটা পরিবার। পরিবারে সব সময়ই নারীর স্বাধীনতা ছিলো। তার বাবা-মা সব সময় চাইতেন যেন সব ছেলে-মেয়েরা সাবলম্বী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।


সুরাইয়া ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন বিজনেস করার। আবার সিনেমায় সাবানাকে উকিলের অভিনয় দেখে মনে হতো উকিল হবেন। একটু বড় হয়ে খুব বামপন্থী বই পড়তেন। তখন মনে হতো বড় হয়ে শ্রমিক নেতা হবেন। আন্দোলন করবেন, মেহনতী মানুষের জন্য কাজ করবেন। এসএসসি পাস করেই রাজনীতি করা শুরু করেন উদ্যোগী এ নারী। সে সময় কয়েকজন বড় ভাই-বোনের সাথে মধুর ক্যানটিনেও কয়েকবার চলে গেছেন তিনি।


তখন চারুকলায় পড়ালেখা করার জন্য ভর্তি পরীক্ষা দেন। কিন্তু ভালো আঁকতে না পারায় চান্স পাননি সুরাইয়া। এইচএসসি পরীক্ষার পরে সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছে হলো তার। কবি শামসুর রহমানের ইন্টারভিউ নিয়ে শুরু হয় তার সাংবাদিকতার। তখন সাপ্তাহিক বিজ্ঞাপন নামের পত্রিকায় গুণীজনের ইন্টারভিউ থাকতো। সেখানে কিছুদিন কাজ করেন। কিন্তু সম্মানি না দেয়ায় সাংবাদিকতা বাদ দেন তিনি।


তেজগাঁও কলেজ থেকে এইচএসসি এবং বিএ পাস করেন সুরাইয়া। পড়ালেখার পাশাপাশি কিছু করতে প্রশিকা নামের একটি এনজিওতে চাকরি নেন। সেই সাথে তিতুমীর কলেজে এমএ ভর্তি হন।



নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সুরাইয়া শারমিন


প্রশিকায় চাকরি করা অবস্থায় বিয়ে করেন নিজের পছন্দে ওই প্রতিষ্ঠানেরই এক সহকর্মীকে। জীবন খুব সুন্দর চলছে। এর মধ্যে বিয়ের দু’মাসের মধ্যে সুরাইয়ার বাবার ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়ে। জীবন হয়ে পরে বিপর্যস্ত। আব্বার ইচ্ছে নাতিনের মুখ দেখার। সে ইচ্ছা পূরণে বাচ্চা নেন। বাচ্চা পৃথিবীর আলোর মুখ দেখার আগেই আব্বা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সময়ের পূর্ণতায় মেয়ে সন্তানের মা হন তিনি। শুরু হলো নতুন সংগ্রাম। মেয়েকে রেখে চাকরি করা কষ্টকর হওয়ায় ছেড়ে দেন চাকরি। মেয়ের আটমাস বয়সে আবার তার নতুন চাকরি হয় কেয়ারে। আটমাস পরে মেয়ে ভীষণ অসুস্থ হলে চাকরি ছেড়ে দেন। এরপরে জীবনের প্রয়োজনে আবারো চাকরি নিতে হলো সেভ দ্য চিলড্রেনের একটা প্রজেক্টে। সেখানে দেখতেন যারা যতবেশি তেলবাজি করেন তারা ভাল সুযোগ-সুবিধা পান। এসব তার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। মেয়ের চার বছর বয়সে ফাইনালি আর চাকরি না করার সিদ্ধান্ত নেন। নিজে থেকে কিছু করার চেষ্টা শুরু করেন।


উৎসবকে কেন্দ্র করে শুরু করেন নতুন বিজনেস। ভালো লাভ না হওয়ায় একটা সময় সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। বসে থাকেন দু-তিন বছর। ২০১০ সালে এক বন্ধুকে দেখে শেয়ার ব্যবসা করার চিন্তা করেন। প্রথমবারে প্রায় ছয় লাখ টাকার শেয়ার কেনেন সুরাইয়া। শেয়ার কেনার পাঁচদিন পর শেয়ার বাজারে নামে ধস। শেয়ার বিক্রি করেননি। ভেবেছিলেন শেয়ারের দাম আবার ঠিক হবে, তাই দাম এডজাস্ট করার জন্য জমি বিক্রি করে আরো প্রায় দুই লাখ টাকার শেয়ার কেনেন তিনি। কিন্তু বিধি বাম! তাতেও কোনো লাভ হলো না। এভাবে জীবনের সব কষ্টের টাকা শেষ করে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। হতাশা আসে জীবনে।


অন্যদিকে তার হাসবেন্ডের অফিস প্রশিকায় কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়। অফিসে দুই গ্রুপের মধ্যে সমস্যা হওয়ায় বেতন অনিয়মিত হয়ে যায়। শেয়ার ব্যবসায় লস। সব মিলিয়ে খুব হতাশ হয়ে পড়েন এ নারী উদ্যোক্তা।


পথে চলতে চলতে হঠাৎ একদিন খেয়াল করেন স্কুলের বেশ কিছু ভাবি ড্রেস, জুয়েলারি, ব্যাগ এনে বিক্রি করছেন। বিষয়টা তার খুবই ভালো লাগে। সবাই ভালো ও স্বচ্ছল পরিবারের। হঠাৎ তার মনে হলো ভাবিরা পারলে আমি কেন পারবো না। আমি তো আগে বুটিক হাউজ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু করতে পারিনি। এবার নতুন করে কিছু শুরু করি। যেই ভাবা সেই কাজ। শীতের সময় পাঁচটা আড়ং শাল কেনেন। শালগুলো কেনার সময় ভেবেছেন বিক্রি হলে হবে, না হলে নিজেই ব্যবহার করবেন। ব্যবসায়ের পুঁজি মাত্র ২০০০ টাকা। পাঁচটা শালের একটা স্কুলে পরে যান। আর শপিং ব্যাগে করে নিয়ে যান চারটা। দশ মিনিটের মধ্যে গায়েরটাসহ পাঁচটা শালই বিক্রি হয়ে যায়। দুই মাসে প্রায় দুইশো শাল বিক্রি করেন। আর দুই হাজার টাকা পুঁজি হয়ে যায় চল্লিশ হাজার টাকায়। এটা ছিলো তার অফলাইনে বিজনেসে ফিরে আসা।


সে থেকে শুরু হলো সুরাইয়ার দেশীয় তাঁত আর দেশীয় পণ্য নিয়ে বিজনেস। কখনো ইন্ডিয়ান বা পাকিস্তানি কোনো ড্রেস নিয়ে কাজ করেননি তিনি। সাধারণত দেশীয় পোশাক ছাড়া কিছু পরেনও না। দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করতেই বেশি আগ্রহবোধ করেন। সুরাইয়ার উৎসবকে কেন্দ্র করে যে বিজনেস শুরু করেছিলেন তখন প্রাধান্য দিয়েছেন পহেলা ফাগুন, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং দুটি ঈদ।



অবসরেনারী উদ্যোক্তা সুরাইয়া শারমিন


একদম দেশীয় পণ্য সামগ্রী যেমন তাঁতের শাড়িতে ব্লক-বাটিকের কাজ করেন সুরাইয়া। বিভিন্ন ড্রেস, শাড়ি ও পাঞ্জাবিতে নিজে ডিজাইন করে সেই ডিজাইনে ব্লক করেন। অনেক দিন থেকেই অফলাইনে বিজনেস করার কারণে তার অফলাইনের মূল কাস্টমার ছিলো পরিবারের সদস্য, মেয়ের স্কুলের ভাবিরা, আশপাশের পরিচিত মানুষ আর তার বন্ধুরা। যেহেতু নিজে ডিজাইন করতেন সেহেতু ড্রেসগুলোর দাম একটু বেশি হতো। এই কারণে কাস্টমার খুব বেশি ছিলো না। কিন্তু এক সময় তাকে এই বিজনেসটাও বন্ধ করে দিতে হয়।


সুরাইয়ার ছোটবেলা থেকেই একটু হারবাল জিনিসের প্রতি ঝোঁক ছিলো বেশি। ছোটবেলায় খেলতে গিয়ে হাত-পা ছিলে বা কেটে গেলে গাদা ফুলের পাতা চিবিয়ে দিয়ে রাখতেন। তার ঠান্ডা লাগলে সরিষার তেল রসুন গরম করে আম্মা দিয়ে দিতেন। কালোজিরা, মেথি আসলে এই সব হারবাল উপাদানের ব্যবহার তার খুব ভাল লাগতো। নারিকেল কুড়িয়ে তেল বানানো। আমলকী শুকিয়ে তেলে দিয়ে দেয়া। সেই ভালো লাগা থেকে আয়ুর্বেদ নিয়ে লেখা অনেক বই পড়েন। তার পর নিজের জন্য আর পরিবারের জন্য হারবাল তেলটা নিয়মিত তৈরি করা শুরু করেন। এক সময় স্কুলের ভাবিরা এরপরে বন্ধু'রা অল্প করে নিয়ে ব্যবহার করতেন। তাদের ভাল লাগলে পরে তেলটা তৈরি করার অনুরোধ করলে শুধু অর্ডার অনুযায়ী তেলটা তৈরি করেন। একসময় দেখেন যে পরিমাণ তেল তৈরি করেন তার চাইতে বেশি অর্ডার আসতে শুরু করে।


সবার চাহিদা দেখে অনলাইন পেজ ‘Suraya’তে সেল আইটেমে তেলটা যোগ করেন সুরাইয়া। তেল টার নাম দেয়া হয় নিজের কন্যা অমরাবতীর নামে। আমরাবতী হারবাল হেয়ার অয়েল। প্রথমে মাসে মাত্র বিশটা তেল তৈরি করেন। তার পর পঞ্চাশটা। আর এখন প্রতি মাসে পাঁচশ তেলের বেশি অর্ডার নেন না। কারণ তার লোকবল যা আছে তাতে এর বেশি তেল বানানো এখনও সম্ভব না। তা হলে কোয়ালিটি ঠিক থাকবে না।


সুরাইয়ার উদ্যোক্তা জীবনের প্রধান অনুপ্রেরণার উৎস হলেন একাত্তর বছর বয়সী তার আম্মা। তার ভাষ্য, আমার আম্মা এখনো কেউ কিছু বললে এগিয়ে যান। আর আম্মার পরে আমার কাজের অনুপ্রেরণা হলেন শ্রমজীবি নারী, যেমন পোশাক শ্রমীকরা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছে। রাস্তার পাশে বসে পিঠা বিক্রেতা নারী। আমি বিশ্বাস করি, কাজ আমার অবস্থান তৈরি করতে সহায়তা করবে।



অমরাবতী হারবাল হেয়ার অয়েল তৈরিতে সুরাইয়া


লেখালেখি করতে ভীষণ পছন্দ করেন সুরাইয়া। সারাদিনের কর্ম ব্যস্ততার মধ্যেও সময় পেলেই লিখতে বসেন তিনি। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে ফেসবুকে লিখেন। বিশেষ করে দীর্ঘ দিন থেকে ছোটগল্প নিয়মিত ধারবাহিকভাবে লিখে আসছেন।


সুরাইয়া চান দেশের হাজারো ভেজাল পণ্যের ভিড়ে অমরাবতী হারবাল হেয়ার অয়েলটা যেন দেশের মানুষের কাছে খাঁটি একটা তেলের উদাহরণ হয়ে থাকে। আর নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি কামনা করেন নারী এই উদ্যোক্তা। তার মতে, নারীকে তার মান সন্মান ও মর্যাদা বোধসম্পন্ন মানুষ হয়ে বাঁচতে হলে সাবলম্বী হতে হবে।


দেশের সোনালী আঁশ পাটকে নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন উদ্যোমী এই উদ্যোক্তা। শুধু নিজে নয় নারীদের নিয়ে দেশীয় তাঁত আর জামদানী নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে তার। অনেক দিন থেকে দেশীয় তাঁত আর জামদানী নিয়ে টুকটাক লেখালেখি করে আসছেন তিনি। তিনি মনে করেন, দেশের সাধারণ মানুষদের দেশীয় পণ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে আর এর জন্য দরকার দেশীয় পণ্যের প্রচার। প্রাচারেই প্রসার। নারীদের মনে রাখতে হবে সাহস আর কাজ করার অদম্য শক্তি। তাহলেই নারীরা পরিবারে ও সমাজে নিজের পরিচয় করে নিতে পারবেন।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/জাই


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com