শিরোনাম
রঙ নিয়ে খেলা করেই জীবন যুদ্ধে জয়ী নিগার সুলতানা
প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২০, ১৩:১৯
রঙ নিয়ে খেলা করেই জীবন যুদ্ধে জয়ী নিগার সুলতানা
খলিলুর রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে আইনজীবী হবেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। আইন বিষয়ে লেখাপড়া শুরু করার আগেই ভেঙে যায় সে স্বপ্ন। শুরু হয় নতুন জীবন। যে জীবনের শুরু থেকে শুধুই ব্যথা আর যন্ত্রণা। তারপরও থেমে যায়নি জীবনের গতি। হাজারো কষ্টকে হার মানিয়ে প্রতিনিয়ত জীবন যুদ্ধ করেছেন। এ যুদ্ধে ছিল হাজারো প্রতিবন্ধকতা। সব কিছুকে পেছনে ফেলে আজ তিনি জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। তবে আইনজীবী নয়, হয়েছেন সফল উদ্যোক্তা।


বলছিলাম কে আর ক্র্যাফট’র ফ্যাশন ডিজাইনার ও উদ্যোক্তা নিগার সুলতানা আল রাজির কথা।



কে আর ক্র্যাফট এর ফ্যাশন ডিজাইনার ও উদ্যোক্তা নিগার সুলতানা আল রাজি


সুলতানার বাবার বাড়ি টাঙ্গাইল জেলায়। বাবা সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় সার কারখানায় চাকরি করতেন। সে সুবাধে ১৯৮৩ সালে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায়ই তার জন্ম। ৫ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। বোনদের মধ্যে তিনি ছাড়া সবাই দেশের বাইরে এবং ভাই সিলেটে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ভাই-বোন সবাই সহজে প্রতিষ্ঠিত হলেও তিনি অনেক সংগ্রাম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সে গল্প অনেকটা সিনেমার কাহিনীকেও হার মানায়।


ফেঞ্চুগঞ্জের সার কারখানায়ই কাটে সুলতানার শৈশব আর কৈশোর। সার কারখানা এলাকায় একটি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা, ১৯৯৫ সালে এনজিএফএফ স্কুল থেকে এসএসসি এবং ফেঞ্চুগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালে সুলতানার পরিবারের কাছে আসে একটি লোভনীয় অফার। আর সে অফার মিস করেননি তার বাবা-মা। কুমিল্লার সরকারি এক চাকরিজীবী ছেলে পেয়ে ওই ছেলের সাথে বিয়ে দেন তাকে।


বাবা-মার কথা মতো সুলতানা মেনে সব কিছু। কিন্তু হাতের মেহেদি রঙ মোছার সাথে সাথেই তার মুছে যায় সংসার জীবনের সকল সুখও। তার উপর শুরু হয় মানসিক ও শারিরীক নির্যাতন। সে নির্যাতনের কথা তিনি পরিবারের সবাইকে জানান। কিন্তু তারা সব সময়ই তা মেনে নেয়ার পরামর্শ দিতেন।


বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সব অত্যাচার নিরবে সয়ে কাটিয়ে দেন ১১টি বছর। এক এক করে দুই সন্তানের মা হন তিনি। নির্যাতনের মাত্রা যখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায় তখন বাধ্য হয়ে স্বামীকে তালাক দিয়ে তিনি বাবা-মায়ের কাছে চলে আসেন টাঙ্গাইলে। এমন দুর্দিনে হতভাগীর বাবা-মায়ের কাছেও স্থান হয়নি। বাবা-মা ও তার পরিবারের অন্য সদস্যরা তাকে তাড়িয়ে দেন।


সুলতানা বলেন, আমি স্বামীকে তালাক দিয়ে যখন বাড়ি যাই, তখন আমার বাবা-মা আমাকে জায়গা দেন নাই। তারা বলেন, আমাদের পরিবারের মেয়েদের বিয়ে দিলে কেউ ফেরত আসে না। মেয়েরা লাল শাড়ি পরে স্বামীর বাড়ি যায়, আর সাদা কাপড় পরে সে বাড়ি থেকে বের হয়। আর এভাবে স্বামীকে তালাক দিয়ে আসা তো অসম্ভব!



কে আর ক্র্যাফট এর শোরুম


এক পর্যায়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। কিছুক্ষণ থেমে আবার জীবনের কাহিনী বলা শুরু করেন সুলতানা।


তিনি বলেন, যখন আমাকে বাবা-মা ও ভাই-বোন তাড়িয়ে দিলো; তখন আমি আমার দুই সন্তান দিয়ে রাজধানীর উত্তরা এলাকায় আসি। অজানা-অচেনা একটা জায়গায় এসে থাকার কোনো জায়গাও ছিল না। অনেক জায়গায় বাসা ভাড়া নিতে গেছি। তখন স্বামী ও বাবা-মার পরিচয় লাগাতে বাসা ভাড়া নিতে পারি নাই। কিন্তু ভাগ্যক্রমে স্বীপন আপা নামের এক মহিলার সাথে আমার পরিচয় হয়। তখন উনাকে আমি আমার সব কষ্টের কথা খুলে বলি। তারপর উনার মাধ্যমে উত্তরা তিন নম্বর সেক্টরে একটি বাসায় উঠি। ১০ হাজার টাকা ভাড়ায় এক রুমের ওই বাসায় কোনো সিকিউরিটি দিতে হয় নাই। স্বীপন আপার অবদানে আমি সেই বাসায় উঠি এবং ফ্লোরে থাকা শুরু করি।


তখন ছিল শীতকাল। এক একটা রাত যেন তার কাছে ছিল একটা বছরের সমান। কারণ তার কোনো বিচানাপত্র ছিল না। দুই সন্তানকে নিয়ে বাসার মেজেতে ঘুমাতে হত। একটা কম্বলও ছিল না। পরনের কাপড় দিয়ে রাত কাটাতে হয়েছে। এছাড়াও বাচ্চাদের তিন দিনে এক বেলা খাবার দেয়ার সামর্থ্য ছিল না তার। স্বীপন আপার প্রতি তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।


সুলতানা বলেন, আমার এই অবস্থা দেখে প্রথম মাসে বাড়ির মালিক আমার কাছ থেকে ভাড়া নেননি। এ জন্য আমি ওই বাসার মালিকের কাছে চির কৃতজ্ঞ।


কিভাবে এ অবস্থা থেকে উঠে এলেন জানতে চাইলে সুলতানা বলেন, বাসায় উঠার পর স্বীপন আপা আমাকে যুব উন্নয়নে নিয়ে যান। পরে সেখানে স্কীন প্রিন্ট, ব্লক ও বুটিকের কাজ শিখি। কাজ শেখার পর উত্তরা এলাকাস্থ বুটিক হাউজগুলোতে যাই। প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে গিয়ে আমি আমার কাজের কথা বলি এবং কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করি। তবে সেই সময় কেউই আমাকে বিশ্বাস করতো না। কারণ অজানা-অচেনা কাউকে কেউই বিশ্বাস করে না। এক পর্যায়ে অনেক অনুরোধ করে একটা বুটিক হাউজে কাজের ব্যবস্থা করি। ওই বুটিক হাউজ যেভাবে কাজ ডেলিভারি দিতে বলতো আমি সে অনুসারে কাজ ডেলিভারি দিয়েছি।


এ প্রসঙ্গে সুলতার ভাষ্য, প্রথম দিকে খুব দ্রুত আর আরজেন্ট কাজ ডেলিভারি দিতে হত। কোনো কোনো সময় অনেক গভীর রাতেও কাজ ডেলিভারি দিতে হয়েছে। একজন নারী হয়ে আমি এভাবে দিনের পর দিন যুদ্ধ করে কাজ সংগ্রহ করে সময় মত বুটিক হাউজগুলোতে কাজ বুঝিয়ে দিতাম।


এভাবে টানা ছয় মাস কাজ করার পর কিছুটা সফল হন উদ্যমী নারী। আয়ের টাকা দিয়ে ধীরে ধীরে বাসায় কিছু জিনিস-পত্র কিনে সন্তানদের নিয়ে একটু ভালোভাবে চলতে থাকেন তিনি। আত্মবিশ্বাস আর কঠোরপরিশ্রমের ফলে ব্যবসায়ও লাভ আসতে থাকে। এক পর্যায়ে ২০১৪ সালে তিনি আড়ংয়ে যান। সেখানে গিয়ে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে নিজের কাজের নমুনা দেখান। তখন একটা কাজের অর্ডার পান।



উদ্যোক্তা সেমিনারে নিগার সুলতানা


২০১৬ সাল। নিজের ব্যবসার উন্নয়নের জন্য তিনি এসএমই ফাউন্ডেশনে যান। সেখানে ই-কার্মাসসহ বিভিন্ন কোর্সের ট্রেনিং করেন। শুধু তাই নয়, ফ্যাশন ডিজাইনার চন্দ্র শেখর সাহার সাথে দীর্ঘ এক বছর কাজ করেন। এ বিষয়ে তার ভাষ্য, শেখর দার সাথে থেকে আমি অনেক কাজ শিখেছি। উনি এখনো আমাকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন।


পাট শিল্প নিয়েও কাজ করছেন সুলতানা। পাট দিয়ে স্কুল ব্যাগ, মহিলাদের ব্যাগ, অফিস ফাইল, বেট সিটসহ নানা ধরনের পণ্য তৈরি করছেন। এসব পণ্য দেশের পাশাপাশি বিদেশেও পাঠাচ্ছেন।


নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, কাজ করতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হত আমাকে দিয়ে হবে না। আমি পারব না। আবার চিন্তা করতাম; আমি যদি না পারি তাহলে আমার দুটি সন্তান কোথায় যাবে। তাদের কিভাবে বড় করবো। তখন ভাবতাম না আমাকে পারতেই হবে। সে আত্মবিশ্বাস থেকেই আমার কাজ চালিয়ে গেছি। তবে অনেক প্রতিবন্ধকতা এসেছে। সবগুলো সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করেছি। কখনো ভাবিনি আমি উদ্যোক্তা হবো। কিন্তু ভাগ্যদেবি আমাকে উদ্যোক্তা বানিয়েছে।


শুধু নারী উদ্যোক্তা হওয়ায় তার রয়েছে নানান ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতা। একটা অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে সুলতানা বলেন, আমি যখন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) এর সদস্য হতে যাই। তখন সেখানের একজন ঊধ্বর্তন কর্মকর্তার কাছে আমি মানসিকভাবে হেনেস্তার শিকার হই। তখন আমি আমার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ওই কর্মকর্তার রুম থেকে বের হয়ে আসি। আমি উনার নামটা মুখে নিতে চাই না।


উদ্যোক্তা জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার উৎস সুলতানার মেয়ে। তিনি বলেন, আমি যখন খুবই অস্থির হয়ে যেতাম। যখন থেমে যাওয়ার চিন্তা করতাম। তখন আমার মেয়ে আমাকে বলত, মা তুমি থেমে যেও না। জানি তুমি পারবে। চালিয়ে যাও। আর তুমি থেমে গেলে আমরা যাব কোথায়। মেয়ের এমন কথাগুলো আমার মনে নতুন করে কাজ করার শক্তি যোগাত। আর কাজ করতে গিয়ে যখন মানুষ জানে আমার স্বামী নাই। তখন সবাই আমাকে বিভিন্ন ফাঁদে ফেলার চিন্তা করে। এই সমাজ ব্যবস্থা মনে হয় না কোনো দিন পরিবর্তন হবে। তবে মানুষের মনে যে দিন এই পরির্তন হবে যে, একটা মেয়ে একা চলছে আমরা তাকে মানসিক ও নৈতিক সাপোর্ট দেই; তখন আমাদের মত মেয়েদের চলতে সহজ হবে।


আবার স্বামীর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে সুলতানা বলেন, আমার সাবেক স্বামী আমাকে এত অবহেলা করত যে, সে সব সময় বলত আমি জীবনে ১০ টাকাও গুণতে পারব না। আমার বাবা-মা আমাকে কিছুই শেখায়নি। শুধু খেলাপড়া টুকু শিখিয়েছে। আমি কিছু করতে পারি না।



ফ্যাশন ডিজাইনার ও উদ্যোক্তা নিগার সুলতানা আল রাজি


সাবেক স্বামীর প্রতি ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এখন আমি অনেক কিছু করতে পারি। আমি অনেক কিছুই শিখেছি। পুরো পরিবার আমার উপর নির্ভর করে।


অবহেলিত নারীদের প্রতি সুলতানার ভাষ্য, আমি পারছি, পারব। আমার মত নির্যাতনের শিকার যেকোনো নারীকেই সাহস করে টিকে থাকতে হবে। তারাও পারবে। কেউ কখনো থেমে যাবেন না। থেমে গেলে চলবে না। নারীরা অনেক কিছুই করতে পারে।


ব্যবসার পাশাপাশি তিনি দুই সন্তানকে নিজের আদর্শে গড়ে তুলছেন। মেয়ে ও ছেলে দুজনই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে লেখাপড়া করছে। বড় ময়ে এ লেভেলে আছে। আর ছেলে তৃতীয় শ্রেণিতে।


দীর্ঘ সময় একা চলার পর জীবনের প্রয়োজনে একজন বিশ্বস্ত জীবন সঙ্গির কথাও ভাবছেন সুলতানা। এ বিষয়ে তিনি বলেন, বিয়ের কথা কখনোই চিন্তা করি নাই। তবে এখন চিন্তাভাবনা করছি। কারণ হচ্ছে অনেক সময় নিজেকে একা ফিল করি। বিভিন্ন দেশে কাজের অফার আসে। তাই জীবন সঙ্গির প্রয়োজন আছে।


বাস্তবতার জন্য অনেকটা অভিমান করেই পরিবারে বাবা-মা ও ভাই-বোন সবার সাথেই যোগাযোগ বন্ধ ছিল। বাবার মৃত্যুর খবর শুনে বাড়িতে গেলে মৃত বাবার মুখটাও তাকে দেখতে দেয়া হয়নি। দূর থেকে বাবাকে শেষ দেখা দেখে চলে আসেন সুলতানা।


মা গ্রামের বাড়িতে আর বোনরা সবাই থাকেন দেশের বাহিরে। ভাই চাকরি করেন সিলেটে। অনেক ইচ্ছে হয় সবার সাথে দেখা করতে, কথা বলতে কিন্তু তারা কেউই সুলতানার সাথে যোগাযোগা করেন না। তবে তিনি তার ভাই-বোনের খোঁজ-খবর রাখেন। সবাই ভালো থাকুক সব সময় এই কামনা করেন তিনি।



কে আর ক্র্যাফট এর ফ্যাশনে কাজে ব্যস্ত কর্মীরা


নিজের অর্জন সম্পর্কে সুলতানা বলেন, ডালিমের খোসা থেকে রঙ হচ্ছে। সেটা আমি কোনো দিন কল্পানা করতে পারিনি। পানের খর থেকে রঙ হচ্ছে। পানের খর থেকে অনেক সুন্দর কালার আসে; সেটা কখনো চিন্তা করা যায় না। এছাড়াও হরতকিসহ বিভিন্ন ধরনের ন্যাচারাল জিনিসগুলো থেকে কালার হচ্ছে। এটা আমার সবচেয়ে বড় অর্জন। আমি রঙ নিয়ে খেলা করি। রঙ নিয়ে খেলা করতে এখন আমার ভালো লাগে।


রাজধানীর উত্তরায় কে আর ক্র্যাফট নামের একটি শো রুম রয়েছে সুলতানার। ওই প্রতিষ্ঠানে এখন ৮০ জন লোক কাজ করছেন। এর মধ্যে ২০ জনই নারী কর্মী।


দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করছেন সংগ্রামী এই উদ্যোক্তা। নিজের কাজের মধ্য দিয়েই বেঁচে থাকতে চান তিনি। স্বপ্ন সম্পর্কে সুলতানা বলেন, আমি না থাকলেও যাতে আমার প্রতিষ্ঠান ও কাজগুলো থাকে সেজন্য আমি কাজ করে যাচ্ছি। আমি আমার কাজে মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকতে চাই।


বিবার্তা/খলিল/উজ্জ্বল/জাই


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com